দরুদে তাজ ইসলামী জিকির ও দরুদসমূহের মধ্যে একটি বিশেষ দরুদ, যা আলেম সমাজ ও সাধারণ মুসলিমদের কাছে অত্যন্ত সম্মানিত ও প্রিয়। এই দরুদে রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে এমনভাবে প্রশংসা করা হয়েছে, যেখানে তাঁর মহত্ত্ব, বরকত, শাফাআত এবং উম্মতের প্রতি তাঁর দয়া একত্রে ফুটে ওঠে। মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে দরুদে তাজ বিশেষ সময় ও উপলক্ষে পাঠ করা হয় — যেমন বরকত কামনা, দুঃসময় থেকে মুক্তি, রোগ থেকে আরোগ্য এবং রিজিকের প্রশস্ততার জন্য।
দরুদে তাজের ভাষা অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী ও অর্থবহ। এতে রাসূল ﷺ-এর প্রতি ভালবাসা, আনুগত্য এবং সালাম প্রেরণের এমন একটি সুন্দর প্রকাশ রয়েছে যা পাঠকের অন্তরকে নরম করে এবং ঈমানকে দৃঢ় করে। অনেক আলেমের মতে, এই দরুদ নিয়মিত পড়লে তা আত্মিক প্রশান্তি আনে, গুনাহ মোচন হয় এবং জীবনে শান্তি ও বরকত নেমে আসে।
এই ব্লগপোস্টে আমরা দরুদে তাজের আরবি পাঠ, বাংলা উচ্চারণ, অর্থ, ফজিলত, পাঠের সঠিক পদ্ধতি, দলিল এবং আলেমদের মতামত বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব, যাতে পাঠক এটি সহজে শিখতে ও আমল করতে পারেন।
দরুদে তাজ কী?
দরুদে তাজ হলো এমন একটি বিশেষ দরুদ, যেখানে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর প্রশংসা, তাঁর প্রতি সালাত ও সালাম এবং তাঁর গুণাবলীর সুন্দর বর্ণনা রয়েছে। এই দরুদে রাসূল ﷺ-কে “তাজ” অর্থাৎ মুকুট হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে, যা বোঝায় যে তিনি সমগ্র সৃষ্টির শিরোমণি। দরুদে তাজ মূলত রাসূল ﷺ-এর শান ও মর্যাদা হৃদয়ে গভীরভাবে অনুভব করার জন্য একটি বিশেষ দোয়া।
দুরুদে তাজ আরবি
اَللّٰهُمَّ صَلِّ وَسَلِّمْ وَبَارِكْ عَلٰى سَيِّدِنَا مُحَمَّدٍ صَاحِبِ التَّاجِ وَالْمِعْرَاجِ وَالْبُرَاقِ وَالْعَلَمِ وَدَافِعِ الْبَلَاءِ وَالْوَبَاءِ وَالْقَحْطِ وَالْمَرَضِ وَالْأَلَمِ وَاسْمِهِ مَكْتُوبٌ مَرْفُوعٌ مَشْفُوعٌ مُنْقُوشٌ فِي اللَّوْحِ وَالْقَلَمِ سَيِّدِ الْعَرَبِ وَالْعَجَمِ جِسْمُهُ مُقَدَّسٌ مُعَطَّرٌ مُطَهَّرٌ مُنَوَّرٌ فِي الْبَيْتِ وَالْحَرَمِ شَمْسِ الضُّحٰى بَدْرِ الدُّجٰى صَاحِبِ الْمَقَامِ الْمَحْمُودِ وَالْحَوْضِ وَاللِّوَاءِ كَاسِرِ الْأَصْنَامِ وَالدَّاعِي إِلٰى دِينِ رَبِّ الْعَرَبِ وَالْعَجَمِ
বাংলা উচ্চারণ: আল্লা-হুম্মা সাল্লি ওয়া সাল্লিম ওয়া বারিক আ’লা সাইয়্যিদিনা মুহাম্মাদিন সাহিবিত তাজি ওয়াল মি’রাজি ওয়াল বুরাকি ওয়াল আলামি, ওয়া দায়িফিল বালাই ওয়াল ওয়াবাই ওয়াল কাহতী ওয়াল মারাদি ওয়াল আলামি, ওয়াসমুহু মাকতুবুম মারফু’উন মাশফু’উন মুনকুশুন ফিল লাওহি ওয়াল কালামি, সাইয়্যিদিল আরাবি ওয়াল আজামি, জিসমুহু মোকাদ্দাসুন মু’আত্তারুন মুতাহ্হারুন মুনাওয়ারুন ফিল বাইতি ওয়াল হারামি, শামসিদ দুহা বাদরিদ দুজা সাহিবিল মাকামিল মাহমুদি ওয়াল হাউজি ওয়াল লিওয়া, কাসিরিল আসনামি ওয়াদ দা’ই ইলা দ্বীনি রব্বিল আরাবি ওয়াল আজামি।
বাংলা অর্থ: হে আল্লাহ, দয়া করে রহমত, সালাম এবং বরকত নাযিল করুন আমাদের নেতা মুহাম্মাদ ﷺ-এর উপর, যিনি তাজ (মুকুট), মি’রাজ, বুরাক ও আলমের অধিকারী। যিনি বালা-মুসিবত, মহামারি, দুর্ভিক্ষ, রোগ ও যন্ত্রণার অপসারণকারী। তাঁর নাম লাওহে মাহফুজ ও কলমে লিখিত, উঁচুতে উন্নীত, শাফাআতের যোগ্য এবং খোদাই করা। তিনি আরব ও আজমের নেতা। তাঁর শরীর পবিত্র, সুগন্ধি, পরিশুদ্ধ ও নূরে ভরপুর। তিনি কা’বা ও হারামের আলোকিত ব্যক্তি, সকালবেলার সূর্য ও রাতের পূর্ণিমা। তিনি সম্মানিত মাকামের মালিক, হাউজে কাউসারের অধিকারী এবং লিওয়ার বাহক। তিনি মূর্তিগুলো ভেঙেছেন এবং আরব ও আজমের রবের দ্বীনের দিকে মানুষকে আহ্বান করেছেন।

দরুদে তাজের ফজিলত ও গুরুত্ব
দরুদে তাজ মুসলিমদের মাঝে একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় দরুদ। এর ফজিলত সম্পর্কে আলেমরা উল্লেখ করেছেন যে—
- বালা-মুসিবত থেকে মুক্তি: দরুদে তাজ নিয়মিত পড়লে আল্লাহ বিপদ, রোগ ও মহামারি দূর করে দেন।
- রিজিকের প্রসারতা: যারা দরুদে তাজ পড়েন, তাদের রিজিক সহজ হয় এবং জীবনে বরকত আসে।
- আত্মিক প্রশান্তি: হৃদয় নরম হয়, ঈমান দৃঢ় হয় এবং অন্তরে শান্তি আসে।
- রাসূল ﷺ-এর ভালোবাসা বৃদ্ধি: এ দরুদে তাঁর গুণাবলী পাঠের মাধ্যমে ভালোবাসা ও আনুগত্য গভীর হয়।
- কিয়ামতের দিনে শাফাআত: আলেমদের মতে, দরুদে তাজের পাঠকারীরা কিয়ামতের দিন রাসূল ﷺ-এর শাফাআতের অধিকারী হবেন।
দুরুদে তাজ কখন পড়া যায়
দুরুদে তাজ পড়ার জন্য নির্দিষ্ট সময় নেই, তবে আলেমরা কয়েকটি সময় বিশেষভাবে সুপারিশ করেছেন:
- শুক্রবার রাতে বা সকালে – কারণ এ দিন দরুদ পড়ার বিশেষ ফজিলত রয়েছে।
- মহামারি, বিপদ বা দুর্যোগের সময়ে – বালা-মুসিবত দূর করার জন্য।
- রোগ-শোকের সময় – আরোগ্যের নিয়তে।
- রিজিকের সংকট বা মানসিক অস্থিরতার সময় – অন্তরে প্রশান্তি ও রিজিকের প্রসারতার জন্য।
- সাধারণ সময়েও – প্রতিদিন নির্দিষ্ট ওয়াজিফা হিসেবে পড়া যায়।
দরুদে তাজ পড়ার পদ্ধতি
দরুদে তাজ পড়া অত্যন্ত সহজ, তবে কয়েকটি আদব অনুসরণ করা ভালো:
- ওজু বা পবিত্র অবস্থায় পড়া – দরুদ পড়া ইবাদত, তাই পবিত্রতা রাখা উত্তম।
- শান্ত মনে বসে পড়া – মনোযোগ সহকারে ধীরে ধীরে পড়া।
- নিয়মিত পড়া – প্রতিদিন বা প্রতি শুক্রবার একটি নির্দিষ্ট সংখ্যা ঠিক করে পড়া।
- দরুদ শুরুর আগে ও পরে অন্য দরুদ পড়া – যেমন দরুদে ইব্রাহিম।
- নিয়ত ঠিক রাখা – রাসূল ﷺ-এর প্রতি ভালোবাসা ও আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পড়া।
দুরুদে তাজের দলিল ও আলেমদের মতামত
যদিও দরুদে তাজ সরাসরি কোনো হাদিস থেকে মروয়ি নয়, তবে রাসূল ﷺ-এর উপর দরুদ পড়া কুরআন ও সহীহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত।
কুরআনের দলিল:
“إِنَّ اللَّهَ وَمَلَائِكَتَهُ يُصَلُّونَ عَلَى النَّبِيِّ يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا صَلُّوا عَلَيْهِ وَسَلِّمُوا تَسْلِيمًا”
অর্থ: “নিশ্চয়ই আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতারা নবীর উপর দরুদ পাঠ করেন। হে ঈমানদারগণ! তোমরা তাঁর উপর দরুদ ও সালাম পাঠ কর।” (সূরা আহযাব: ৫৬)
আলেমদের মতামত: আলেমরা বলেছেন, রাসূল ﷺ-এর প্রশংসা, দরুদ ও সালাম যেকোনো ভাষায় পাঠ করা জায়েজ। দরুদে তাজ যেহেতু রাসূল ﷺ-এর প্রশংসাসূচক এবং দরুদ সম্বলিত, তাই এটি পড়া উত্তম এবং ফজিলতময়।
দরুদে তাজ সম্পর্কিত জনপ্রিয় প্রশ্নোত্তর
প্রশ্ন: দরুদে তাজ কি হাদিসে আছে?
উত্তর: না, দরুদে তাজ কোনো সহীহ হাদিস থেকে প্রমাণিত নয়। তবে এর অর্থ ও বিষয়বস্তু কুরআন-সুন্নাহর পরিপন্থী নয়।
প্রশ্ন: কতবার পড়া উচিত?
উত্তর: নির্দিষ্ট সংখ্যা নেই। ১ বার, ৩ বার, ১১ বার বা ইচ্ছেমতো পড়া যায়। নিয়মিত পড়লে বেশি উপকার হয়।
প্রশ্ন: কি ওয়াজিফা হিসেবে পড়া যায়?
উত্তর: হ্যাঁ, অনেকে প্রতিদিন সকালে বা রাতে নিয়মিত পড়েন।
প্রশ্ন: অসুস্থের উপর পড়ে ফুঁ দেওয়া যায় কি?
উত্তর: হ্যাঁ, নিয়ত ঠিক থাকলে জায়েজ।
দরুদে তাজের উপকারিতা (রুহানি ও মানসিক প্রভাব)
- অন্তরে প্রশান্তি আসে ও ভয়-উদ্বেগ দূর হয়।
- আল্লাহর রহমত নাযিল হয়।
- রাসূল ﷺ-এর শাফাআতের আশা জাগে।
- গুনাহ মাফের সম্ভাবনা বাড়ে।
- রিজিক, স্বাস্থ্যে ও জীবনে বরকত আসে।
- মানসিক শান্তি ও আত্মিক শক্তি বৃদ্ধি পায়।
সতর্কতা ও করণীয় বিষয়
- দরুদে তাজকে বাধ্যতামূলক ইবাদত মনে করা যাবে না।
- সংখ্যা বা সময় নিয়ে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করা ঠিক নয়।
- এর ফজিলতকে সহীহ হাদিসের সমতুল্য হিসেবে দেখানো উচিত নয়।
- অর্থ বোঝার চেষ্টা করা ভালো, যাতে ভালোবাসা ও আনুগত্য বৃদ্ধি পায়।
উপসংহার
দরুদে তাজ এমন এক মহামূল্যবান দরুদ যা শুধু জিহ্বায় নয়, হৃদয়েও রাসূল ﷺ-এর প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও আনুগত্যকে দৃঢ় করে। এ দরুদ পাঠের মাধ্যমে মুসলিম তার নবীর গুণাবলী স্মরণ করে, তাঁর প্রতি সালাত ও সালাম প্রেরণ করে এবং আল্লাহর কাছে রহমত প্রার্থনা করে। ফলে পাঠকের অন্তর নরম হয়, ঈমান মজবুত হয় এবং আত্মিক প্রশান্তি নেমে আসে।
যদিও দরুদে তাজ সহীহ হাদিস থেকে সরাসরি মروয়ি নয়, তবুও এর অর্থে এমন কিছু নেই যা কুরআন বা সুন্নাহর বিপরীত। বরং এর প্রতিটি শব্দ রাসূল ﷺ-এর মর্যাদা ও আল্লাহর প্রশংসা বাড়ানোর মাধ্যম। এজন্য আলেমরা বলেছেন, এ দরুদ পড়া জায়েজ এবং এটি নেক আমলের অন্তর্ভুক্ত।
নিয়মিত দরুদে তাজ পড়া মুসলিম জীবনে রুহানি পরিবর্তন আনে—
- অন্তরে আল্লাহর প্রতি ভয় ও রাসূল ﷺ-এর প্রতি ভালোবাসা বৃদ্ধি পায়।
- বিপদ-আপদ, রোগ-শোক ও মানসিক অস্থিরতা থেকে মুক্তির আশা তৈরি হয়।
- রিজিকে বরকত আসে এবং দুনিয়াবি সমস্যায় সহজতা আসে।
- হৃদয়ে এক ধরনের প্রশান্তি ও তাওয়াক্কুল গড়ে ওঠে।
তবে মনে রাখতে হবে, দরুদে তাজকে ফরজ বা ওয়াজিব ইবাদতের মর্যাদা দেওয়া যাবে না। এটি একটি সুন্দর, হৃদয়গ্রাহী দরুদ, যা সুন্নাহ অনুযায়ী দরুদ পাঠের সাধারণ নির্দেশনার অন্তর্ভুক্ত। তাই ভালোবাসা, নিয়ত ও মনোযোগ সহকারে এটি পড়লে জীবনে বরকত ও আত্মিক শক্তি বৃদ্ধি পাবে।