ইসলামে দরুদ শরীফ পাঠ করা এক মহৎ আমল। মহান আল্লাহ্ তাআলা কুরআনে ঘোষণা করেছেন যে, তিনি নিজে ও তাঁর ফেরেশতাগণ নবী করীম ﷺ-এর উপর দরুদ পাঠ করেন, আর মুমিনদেরকেও এ নির্দেশ দিয়েছেন। দরুদ পাঠের মাধ্যমে বান্দা রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর প্রতি ভালোবাসা ও সম্মান প্রকাশ করে এবং নিজের জন্য অফুরন্ত বরকত, রহমত ও শান্তি অর্জন করে। এই দরুদ শরীফের বিভিন্ন রূপ ও পরিচিত নাম রয়েছে। এর মধ্যে “দুরুদে হাজারী” বিশেষভাবে পরিচিত, কারণ ধারাবাহিকভাবে এটি পাঠ করলে হাজারো রহমত ও বরকত লাভ হয় বলে আলেমগণ উল্লেখ করেছেন।
বহু আলেম, ওলিতে করামাত, এবং সাধারণ মুসলমানদের জীবনে এ দরুদের প্রভাব সম্পর্কে কাহিনি প্রচলিত আছে। তাই দরুদে হাজারী মুসলিম সমাজে একটি গুরুত্বপূর্ণ দোয়া ও ইবাদত হিসেবে ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।
এই লেখায় আমরা দরুদে হাজারীর আরবি পাঠ, এর অর্থ, ফজিলত, এবং কিভাবে ও কখন পড়া যায়—এসব বিষয় বিস্তারিত আলোচনা করব।
দুরুদে হাজারী কী?
দরুদে হাজারী হল দরুদ শরীফের একটি বিশেষ রূপ, যা নবী করীম ﷺ-এর উপর পাঠ করা হয়। “হাজারী” নামকরণ করা হয়েছে এ কারণে যে, এ দরুদ একবার পড়লে তা হাজার দরুদের সমান সওয়াব পাওয়া যায় বলে আলেমগণ উল্লেখ করেছেন। বহু অলী-আউলিয়া এবং সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে এ দরুদ পাঠের আমল প্রচলিত এবং তারা এর মাধ্যমে নানাবিধ কল্যাণ ও রহমত লাভের কথা বলেছেন।
আরবি
اللَّهُمَّ صَلِّ أَفْضَلَ صَلَاةٍ عَلَى أَسْعَدِ مَخْلُوقَاتِكَ سَيِّدِنَا مُحَمَّدٍ، وَعَلَى آلِهِ وَصَحْبِهِ، وَسَلِّمْ عَدَدَ مَعْلُومَاتِكَ وَمِدَادَ كَلِمَاتِكَ كُلَّمَا ذَكَرَكَ الذَّاكِرُونَ، وَغَفَلَ عَنْ ذِكْرِكَ الْغَافِلُونَ
বাংলা উচ্চারণ “আল্লাহুম্মা সাল্লি আফদ্বলা সালাতিন আলা আসআদি মাখলুকাতিকা সাইয়্যিদিনা মুহাম্মাদ, ওয়া আলা আলিহি ওয়া সাহ্বিহি, ওয়া সাল্লিম আদাদা মাআলুমাতিকা ওয়া মিদাদা কালিমাতিকা, কুল্লামা যাকারাকা যাকিরুনা, ওয়া গাফালা আন্জিকরিকা গাফিলুন।”
অর্থ “হে আল্লাহ, আপনার সৃষ্টিজগতে সর্বশ্রেষ্ঠ মহাসুখী বান্দা, আমাদের প্রিয়নবী মুহাম্মদ ﷺ-এর উপর সর্বোত্তম দরুদ প্রেরণ করুন। তাঁর পরিবার ও সাহাবীদের উপরও প্রেরণ করুন। আপনার অগণিত জ্ঞান অনুযায়ী এবং আপনার অসীম কালামের কালি অনুযায়ী, যতবারই আপনাকে স্মরণকারী লোকেরা স্মরণ করে এবং গাফিল লোকেরা আপনাকে স্মরণ করা থেকে গাফিল থাকে, ততবারই দরুদ ও সালাম প্রেরণ করুন।”

আরো পড়ুন:
দুরুদে হাজারী এর ফজিলত
১. হাজার দরুদের সমান সওয়াব
দরুদে হাজারী এমন এক বিশেষ দরুদ যা একবার পড়লে হাজার দরুদের সওয়াব পাওয়া যায় বলে আলেমগণ উল্লেখ করেছেন। এজন্য এর নামকরণ করা হয়েছে “হাজারী”।
২. রহমত ও বরকতের দ্বার খুলে যায়
যে ব্যক্তি এ দরুদ পাঠ করে, আল্লাহ তার উপর রহমতের দরজা খুলে দেন। জীবনে নানাবিধ কল্যাণ, বরকত ও প্রশান্তি লাভ করে।
৩. গুনাহ মাফের উপায়
রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর উপর দরুদ পাঠ করলে আল্লাহ তা’আলা পাঠকের গুনাহ মাফ করে দেন। দরুদে হাজারী যেহেতু বিশিষ্ট দরুদ, তাই এ দরুদ পাঠের মাধ্যমে বান্দা বিশেষ মাগফিরাত পেয়ে থাকে।
৪. দুনিয়া ও আখিরাতের সমস্যার সমাধান
ওলী-আউলিয়াদের বর্ণনায় আছে—যারা দরুদে হাজারীকে নিয়মিত আমল করেছেন, তারা দুনিয়ার বহু বিপদ থেকে মুক্তি পেয়েছেন। একইসাথে আখিরাতের মুক্তি লাভের আশ্বাসও রয়েছে।
৫. নবী করীম ﷺ-এর সুপারিশ লাভ
দরুদ শরীফের সবচেয়ে বড় ফজিলত হলো, এটি পাঠ করলে নবী করীম ﷺ-এর সুপারিশ বা শাফা’আত লাভ করা যায়। দরুদে হাজারীও এ শাফা’আতের উজ্জ্বল মাধ্যম।
৬. অন্তরে শান্তি ও প্রশান্তি
নিয়মিত দরুদে হাজারী পাঠ করলে অন্তরে এক ধরনের প্রশান্তি ও মানসিক শক্তি তৈরি হয়। দুশ্চিন্তা ও ভয়-ভীতির অবসান ঘটে।
কীভাবে ও কখন পড়া যায়
১. নির্দিষ্ট সময় ছাড়া যেকোনো সময়
দরুদে হাজারী পড়ার জন্য কোনো নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেওয়া হয়নি। মুমিন বান্দা ইচ্ছা করলে সকাল, সন্ধ্যা, রাত—যে কোনো সময় এ দরুদ পাঠ করতে পারে। তবে বিশেষ অবস্থায় পড়লে এর প্রভাব বেশি অনুভূত হয়।
২. নামাজের পর আমল হিসেবে
পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামাজের পর একবার হলেও দরুদে হাজারী পড়া উত্তম। এতে নামাজের সওয়াবের সাথে দরুদের সওয়াবও যুক্ত হয়ে যায়।
৩. কষ্ট ও বিপদে পড়লে
জীবনে যখন দুশ্চিন্তা, কষ্ট বা বিপদ আসে, তখন দরুদে হাজারী পড়লে অন্তর শান্ত হয় এবং আল্লাহর রহমতে সমস্যা থেকে মুক্তির পথ সুগম হয়।
৪. নিয়মিত নির্দিষ্ট সংখ্যায় আমল
অনেকে প্রতিদিন ১০০ বার বা ১,০০০ বার দরুদে হাজারী পড়াকে নিয়মিত আমল হিসেবে গ্রহণ করেন। আলেমগণ বলেছেন, সংখ্যার সাথে ধারাবাহিকতাই মূল বিষয়।
৫. বিশেষ সময়ে পড়া
- জুমার দিন ও রাত: এ দিনে নবী ﷺ-এর উপর বেশি দরুদ পাঠ করতে উৎসাহিত করা হয়েছে। দরুদে হাজারী এ সময় পড়া অত্যন্ত ফজিলতময়।
- রাতের শেষ প্রহর: তাহাজ্জুদ বা ইস্তিগফারের সময় দরুদে হাজারী পড়লে দোয়া কবুলের আশা আরও বৃদ্ধি পায়।
- মসজিদে প্রবেশ ও বের হওয়ার সময়: দরুদে হাজারী পাঠ করলে এ আমল আরও বরকতময় হয়।
৬. দোয়ার আগে ও পরে
দোয়া করার সময় আগে দরুদ, শেষে দরুদ পড়তে হয়। দোয়ার আগে ও পরে দরুদে হাজারী পাঠ করলে দোয়া কবুল হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়।
কুরআন ও হাদিস থেকে প্রমাণ
কুরআন থেকে প্রমাণ
আল্লাহ তাআলা কুরআনে মুমিনদেরকে নবী করীম ﷺ-এর উপর দরুদ পাঠ করতে স্পষ্টভাবে নির্দেশ দিয়েছেন—
إِنَّ اللَّهَ وَمَلَائِكَتَهُ يُصَلُّونَ عَلَى النَّبِيِّ ۚ يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا صَلُّوا عَلَيْهِ وَسَلِّمُوا تَسْلِيمًا
(সুরা আহযাব, ৩৩:৫৬)
বাংলা অনুবাদ: “নিশ্চয়ই আল্লাহ এবং তাঁর ফেরেশতারা নবীর উপর দরুদ পাঠ করেন। হে ঈমানদারগণ! তোমরাও তাঁর উপর দরুদ পাঠ কর এবং সালাম পাঠ কর প্রচুর পরিমাণে।”
➡️ এ আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয়, নবী করীম ﷺ-এর উপর দরুদ পাঠ করা প্রত্যেক মুমিনের দায়িত্ব ও ইবাদত। দরুদে হাজারীও এ নির্দেশের অন্তর্ভুক্ত।
হাদিস থেকে প্রমাণ
১. দরুদ পড়লে আল্লাহ রহমত নাজিল করেন
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:
“যে ব্যক্তি আমার উপর একবার দরুদ পাঠ করে, আল্লাহ তার উপর দশবার রহমত বর্ষণ করেন।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৪০৮)
২. দুরুদ দোয়া কবুলের মাধ্যম
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:
“যখন তোমরা দোয়া করবে, তখন প্রথমে আমার উপর দরুদ পাঠ কর, পরে তোমাদের প্রয়োজন ব্যক্ত কর। কেননা দরুদ ছাড়া দোয়া আকাশ ও পৃথিবীর মাঝে ঝুলে থাকে।” (তিরমিজি, হাদিস: ৪৮৬)
৩. দুরুদ পাঠকারীর গুনাহ মাফ
হাদিসে এসেছে:
“যে ব্যক্তি আমার উপর দরুদ পাঠ করে, তার দশটি গুনাহ মাফ করা হয়, তার মর্যাদা দশ ডিগ্রি বৃদ্ধি পায় এবং তার জন্য দশটি নেকি লেখা হয়।” (নাসাঈ, হাদিস: ১২৯৭)
দুরুদে হাজারীর বিশেষ আমল সম্পর্কিত
যদিও কুরআন ও হাদিসে সরাসরি “দরুদে হাজারী” নাম উল্লেখ নেই, তবে আলেমরা বলেন, দরুদে হাজারীও রাসূল ﷺ-এর উপর দরুদ পাঠেরই একটি রূপ। তাই এর পাঠ করা সম্পূর্ণ বৈধ, এবং এর ফজিলত সাধারণ দরুদের ফজিলতের অন্তর্ভুক্ত। অনেক ওলী-আউলিয়ার অভিজ্ঞতা অনুযায়ী এটি বিশেষভাবে উপকারী আমল।
দুরুদে হাজারী ও ফিকহি দৃষ্টিকোণ
১. এটা পাঠের মূল হুকুম
ফিকহ অনুযায়ী, নবী করীম ﷺ-এর উপর দরুদ পাঠ করা ওয়াজিব। তবে প্রতিটি নামাজে অন্তত একবার (তাশাহহুদে) দরুদ পাঠ করা ফরজ বা ওয়াজিবের স্তরে চলে আসে। এ ছাড়া বেশি বেশি দরুদ পড়া সুন্নাত ও নফল ইবাদত হিসেবে গণ্য হয়।
২. নির্দিষ্ট দরুদের ব্যাপারে শারঈ অবস্থান
কুরআন ও সহিহ হাদিসে দরুদ পাঠের সাধারণ নির্দেশ এসেছে। কিন্তু দরুদের নির্দিষ্ট কোনো ফরমুলার বাধ্যবাধকতা নেই। সাহাবায়ে কেরাম বিভিন্নভাবে দরুদ পাঠ করতেন, আর রাসূল ﷺ তাদেরকে অনুমোদন দিতেন। তাই আলেমগণ বলেন—
- যে কোনো দরুদ পাঠ করা জায়েয।
- দরুদে হাজারীও একটি বৈধ রূপ, যেহেতু এতে শিরক, বিদআত বা কুরআন-হাদিস বিরোধী কোনো বিষয় নেই।
৩. বিশেষ ফজিলত নিয়ে ফিকহি মতামত
- কিছু আলেম বলেন, দরুদে হাজারীসহ নির্দিষ্ট নামের দরুদগুলোর ফজিলত মূলত অভিজ্ঞতা ও মুজর্ব (পরীক্ষিত আমল) হিসেবে এসেছে, সরাসরি সহিহ হাদিস দ্বারা নয়।
- তাই এ দরুদকে নফল আমল হিসেবে পড়া যায়, তবে এটিকে অপরিহার্য বা ফরজ-সুন্নাতের স্থলাভিষিক্ত করা যাবে না।
৪. আমলের ক্ষেত্রে পরিমিতি
ফিকহের দৃষ্টিতে দরুদে হাজারীসহ যেকোনো দরুদ পড়া জায়েয, তবে—
- এটিকে বাধ্যতামূলক বলে গণ্য করা যাবে না।
- এটিকে একমাত্র গ্রহণযোগ্য দরুদ বলা যাবে না।
- বরং দরুদে ইবরাহিমী (যা নামাজে পড়া হয়) সর্বোত্তম ও সহিহ দরুদ।
৫. উপসংহার
দরুদে হাজারী পড়া জায়েয এবং এটি একটি কল্যাণকর আমল। তবে এর বিশেষ নাম ও ফজিলতকে সরাসরি সহিহ হাদিসের সাথে যুক্ত করা সঠিক নয়। এটি আলেমদের পরীক্ষিত আমল ও অভিজ্ঞতার অন্তর্ভুক্ত। তাই একজন মুসলমান চাইলে এটি নিয়মিত আমল করতে পারে, কিন্তু ফরজ-সুন্নাত দরুদের বিকল্প বানানো উচিত নয়।
দুরুদে হাজারী । সাধারণ প্রশ্নোত্তর
প্রশ্ন ১: এই দুরুদ কি কুরআন বা হাদিসে আছে?
উত্তর: কুরআন ও হাদিসে “দরুদে হাজারী” নামে কোনো দরুদ উল্লেখ নেই। তবে সাধারণভাবে দরুদ পাঠের নির্দেশ রয়েছে। দরুদে হাজারী সেই নির্দেশের অন্তর্ভুক্ত একটি বৈধ রূপ।
প্রশ্ন ২: দরুদে হাজারী পড়া কি জায়েয?
উত্তর: হ্যাঁ, জায়েয। কারণ এতে শিরক, বিদআত বা শরীয়তবিরোধী কিছু নেই। তবে এটিকে ফরজ বা সুন্নাত দরুদের বিকল্প মনে করা যাবে না।
প্রশ্ন ৩: কেন একে ‘হাজারী’ বলা হয়?
উত্তর: কারণ এটি একবার পড়লে হাজার দরুদের সমান সওয়াব হয় বলে আলেমগণ উল্লেখ করেছেন। যদিও এটি সরাসরি সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত নয়, বরং অভিজ্ঞতা ও মুজর্ব আমল হিসেবে পরিচিত।
প্রশ্ন ৪: দুরুদে হাজারী কখন পড়া উত্তম?
উত্তর: যেকোনো সময় পড়া যায়। তবে বিশেষভাবে জুমার দিন-রাতে, নামাজ শেষে, দোয়ার আগে-পরে এবং দুশ্চিন্তার সময়ে পড়া উত্তম।
প্রশ্ন ৫: দুরুদে হাজারীর চেয়ে উত্তম কোনো দরুদ আছে কি?
উত্তর: হ্যাঁ। দরুদে ইবরাহিমী (যা নামাজে পড়া হয়) সর্বোত্তম দরুদ। এর সাথে দরুদে হাজারীসহ অন্য দরুদও আমল করা যেতে পারে।
প্রশ্ন ৬: কতবার পড়া উচিত?
উত্তর: নির্দিষ্ট সংখ্যা নেই। অনেকে দৈনিক ১০০ বার বা ১,০০০ বার পড়েন। সংখ্যা অপেক্ষা নিয়মিততা ও আন্তরিকতা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।