নাপাক বিছানায় ঘুমানো যাবে? হাদিস ও ফাতাওয়া

পোস্টটি শেয়ার করুন

ইসলামে পবিত্রতা রক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং তা ইবাদতের মূল শর্তগুলোর একটি। শুধু নামাজের জন্য নয়, দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা ইসলামের নির্দেশনা। ঘুম একটি স্বাভাবিক চাহিদা, যা বিশ্রাম ও কর্মশক্তি পুনরুদ্ধারের জন্য অপরিহার্য। কিন্তু যদি বিছানা নাপাক থাকে, তাহলে তা শরীর ও পোশাক নাপাক করার সম্ভাবনা তৈরি করে, যা ইবাদতের বিশুদ্ধতা নষ্ট করতে পারে।

পবিত্রতা সংক্রান্ত ইসলামের বিধানসমূহ পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, রাসূলুল্লাহ ﷺ সবসময় পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি শোয়ার আগে ওজু করা, বিছানা ঝেড়ে নেওয়া এবং পবিত্র অবস্থায় ঘুমানোর পরামর্শ দিয়েছেন। তাই একজন মুসলিমের উচিত নাপাক বিছানায় ঘুমানোর ব্যাপারে সচেতন হওয়া এবং শরীর, কাপড় ও আশপাশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা।

নাপাক বিছানায় ঘুমানো যাবে?

না, নাপাক বিছানায় ঘুমানো উচিত নয়। ইসলামী শরিয়তে পবিত্রতা রক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি বিছানায় নাপাকি লেগে যায়, তাহলে তা পরিষ্কার করে নেওয়া জরুরি। কারণ, নাপাকি থাকা অবস্থায় ঘুমালে শরীরে বা কাপড়ে নাপাকি লেগে যেতে পারে, যা নামাজের জন্য পবিত্রতার শর্তের পরিপন্থী হতে পারে।

কিছু করণীয়:

  • যদি বিছানার চাদর বা কম্বল নাপাক হয়ে যায়, তবে তা ধুয়ে ফেলা বা পরিবর্তন করা উচিত।
  • যদি পুরো বিছানা নাপাক হয়ে যায় এবং ধোয়া সম্ভব না হয়, তবে শুকনো কাপড় বা চাদর বিছিয়ে তার ওপর ঘুমানো যেতে পারে, যাতে নাপাকি শরীরে না লাগে।
  • যদি নিশ্চিত না হন যে বিছানা নাপাক হয়েছে কি না, তবে সন্দেহের কারণে অযথা কষ্ট করা উচিত নয়।

🔹 রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:

“নিশ্চয়ই ইসলামে কঠোরতা নেই।” (বুখারি ৩৯)

অতএব, পরিচ্ছন্নতা বজায় রেখে বিছানা ব্যবহারের চেষ্টা করা উচিত।

নাপাক বিছানায় ঘুমানোর বিষয়ে সরাসরি কোনো হাদিস নেই, তবে পবিত্রতা রক্ষা করা এবং নাপাকি থেকে দূরে থাকার ব্যাপারে অনেক হাদিস রয়েছে, যা এই বিষয়ে নির্দেশনা দেয়।

১. পবিত্রতা সংক্রান্ত মূলনীতি

রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:

“পবিত্রতা হলো ঈমানের অর্ধেক।” (সহিহ মুসলিম: ২২৩)

এটি নির্দেশ করে যে, একজন মুসলিমের জন্য পবিত্রতা রক্ষা করা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। নাপাক বিছানায় ঘুমালে শরীর ও কাপড় নাপাক হয়ে যেতে পারে, যা নামাজসহ অন্যান্য ইবাদতের জন্য বাধা সৃষ্টি করতে পারে।

২. নাপাক বস্তু থেকে বেঁচে থাকা

আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:

“নিশ্চয়ই আমার উম্মতের জন্য মাটি (পবিত্র মাটি) উত্তম পবিত্রকারী, যদি তারা পানি না পায়।” (সুনান আবু দাউদ: ৩৩২, তিরমিজি: ১২৪)

এখান থেকে বোঝা যায়, ইসলাম পবিত্রতা রক্ষার প্রতি অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়। নাপাকি থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করা এবং পরিষ্কার থাকা অপরিহার্য।

৩. নাপাকি থেকে বাঁচার আদেশ

রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:

“নিশ্চয়ই মুসলিম ব্যক্তির পোশাক এবং শরীর পবিত্র থাকা উচিত।” (জামে আত-তিরমিজি: ২৭৯৯)

এটি বোঝায় যে, নাপাকি শরীরে বা কাপড়ে লাগলে তা পরিষ্কার করা জরুরি। যদি বিছানা নাপাক হয় এবং তা শরীরের সাথে সংস্পর্শে আসে, তবে তা অপবিত্রতার কারণ হতে পারে।

হানাফি মাযহাবের অভিমত

হানাফি মাযহাবে নাপাক বিছানায় ঘুমানোর বিষয়ে মূলনীতি হলো: যদি বিছানার নাপাকি শুকিয়ে যায় এবং তা শরীর বা কাপড়ে স্থানান্তরিত হওয়ার আশঙ্কা না থাকে, তাহলে সে বিছানায় ঘুমানো নাজায়েজ নয়। তবে তা অপছন্দনীয় (মাকরুহ) হিসেবে গণ্য হবে, কারণ ইসলামে পবিত্রতা বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

মূলনীতি ও দলিল

১. নাপাকির সংস্পর্শ এলে তা দূর করা জরুরি:

হানাফি ফিকহ মতে, শরীর বা কাপড়ে নাপাকি লেগে গেলে তা ধুয়ে পরিষ্কার করা ওয়াজিব (বাহরুর রায়েক ১/২২৪)।

কুরআনে এসেছে:

وَثِيَابَكَ فَطَهِّرْ

“আর তোমার পোশাক পবিত্র রাখো।” (সূরা মুদ্দাসসির: ৪)

২. শরীরে বা কাপড়ে নাপাকি না লাগলে কোনো সমস্যা নেই:

  • হানাফি ফিকহে বলা হয়েছে, যদি নাপাকি শুকিয়ে যায় এবং শরীরে বা কাপড়ে না লাগে, তাহলে সেখানে বসা বা শোয়া নিষিদ্ধ নয়, তবে তা অপছন্দনীয় (মাকরুহ) (আল-ফাতাওয়াল-হিন্দিয়া ১/৫১)।

ফতোয়া অনুযায়ী সিদ্ধান্ত:

✅ যদি বিছানার নাপাকি শুকিয়ে যায় এবং শরীর বা কাপড়ে না লাগে, তাহলে ঘুমানো জায়েজ তবে মাকরুহ।
❌ যদি বিছানায় ভেজা নাপাকি থাকে, যা শরীর বা কাপড়ে লেগে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে, তাহলে সে বিছানায় ঘুমানো নাজায়েজ।

নাপাক বিছানায় ঘুমানো সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন ও উত্তর

প্রশ্ন ১: নাপাক বিছানায় ঘুমানো কি ইসলামে সম্পূর্ণ হারাম?

উত্তর: না, এটি সরাসরি হারাম নয়, তবে এটি মাকরুহ (অপছন্দনীয়) হতে পারে। যদি নাপাকি শুকিয়ে যায় এবং শরীর বা কাপড়ে না লাগে, তাহলে ঘুমানো জায়েজ। কিন্তু যদি নাপাকি ভেজা থাকে এবং শরীরে লাগার আশঙ্কা থাকে, তাহলে সেখানে ঘুমানো নাজায়েজ।

প্রশ্ন ২: যদি কেউ না জেনে নাপাক বিছানায় ঘুমিয়ে ফেলে, তবে কি তার নামাজ বা পবিত্রতা নষ্ট হবে?

উত্তর: যদি ঘুমানোর পর শরীরে বা কাপড়ে কোনো নাপাকি না পাওয়া যায়, তাহলে পবিত্রতা নষ্ট হবে না এবং নামাজের জন্য নতুনভাবে কিছু করার প্রয়োজন নেই। তবে যদি নাপাকি লেগে যায়, তাহলে তা ধুয়ে ফেলা এবং ওজু বা গোসল করে নামাজ পড়া আবশ্যক।

প্রশ্ন ৩: যদি নাপাক বিছানায় থাকে এবং ধোয়া সম্ভব না হয়, তবে ঘুমানো যাবে কী?

উত্তর: যদি বিছানা ধোয়া সম্ভব না হয়, তবে পবিত্র একটি চাদর বা কাপড় বিছিয়ে তার ওপর ঘুমানো যাবে, যাতে নাপাকি শরীরে না লাগে।

প্রশ্ন ৪: রাসূলুল্লাহ ﷺ কি এ বিষয়ে কোনো দিকনির্দেশনা দিয়েছেন?

উত্তর: সরাসরি নাপাক বিছানায় ঘুমানোর বিষয়ে নির্দিষ্ট কোনো হাদিস নেই। তবে রাসূলুল্লাহ ﷺ পবিত্রতা বজায় রাখার প্রতি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছেন এবং শোয়ার আগে বিছানা ঝেড়ে নেওয়ার আদেশ দিয়েছেন।

📖 হাদিস: আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:

“যখন তোমাদের কেউ তার বিছানায় যায়, সে যেন তার চাদর দিয়ে বিছানাটি ঝেড়ে নেয়, কারণ সে জানে না তার পরে সেখানে কী এসেছে।” (সহিহ বুখারি: ৬৩২০, সহিহ মুসলিম: ২৭১৪)

প্রশ্ন ৫: যদি ছোট বাচ্চা বিছানায় নাপাক করে দেয়, তবে কি পুরো বিছানা ধোয়া লাগবে?

উত্তর: না, পুরো বিছানা ধোয়ার প্রয়োজন নেই। কেবল যেই অংশে নাপাকি লেগেছে, সেটি ধুয়ে ফেলা বা মুছে ফেলা যথেষ্ট হবে। তবে সম্ভব হলে চাদর পরিবর্তন করাই উত্তম।

প্রশ্ন ৬: নাপাক বিছানায় ঘুমালে কি দুআ কবুল হবে না?

উত্তর: দুআ কবুল হওয়ার জন্য অন্তরের উপস্থিতি ও ইখলাস (আন্তরিকতা) জরুরি। তবে পবিত্রতা ইসলামে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তাই পরিচ্ছন্ন থাকা দুআ কবুলের একটি মাধ্যম হতে পারে।


পোস্টটি শেয়ার করুন