নূর বৃদ্ধির দোয়া । বাংলা । আরবি । অর্থ । সময় ও ফজিলত

পোস্টটি শেয়ার করুন

নূর বৃদ্ধির দোয়া । নূর বা আলোর বৃদ্ধি বলতে সাধারণত দুই ধরনের নূর বোঝানো হয়—একটি বাহ্যিক, যা চেহারা, দৃষ্টিশক্তি ও হৃদয়ের জ্যোতি বৃদ্ধি করে, এবং অপরটি অভ্যন্তরীণ, যা ঈমানের আলো, হিদায়াত ও আত্মার প্রশান্তি বাড়িয়ে তোলে।

ইসলামে ‘নূর’ শব্দটি কুরআন ও হাদিসে বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা নিজেকে “নূরুস্ সামাওয়াতি ওয়াল আরদ” (আকাশ ও পৃথিবীর নূর) হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন (সূরা নূর: ৩৫)। পাশাপাশি, নবীজি (ﷺ) বিভিন্ন দোয়ায় আল্লাহর কাছে নূর বৃদ্ধির জন্য আবেদন করেছেন, যাতে তাঁর হৃদয়, দৃষ্টি, শ্রবণশক্তি ও চারপাশ আলোকিত হয়।

নূর বৃদ্ধির দোয়া বিশেষত তারা পড়তে পারেন, যারা ইলম অর্জন করছেন, দুনিয়ার অন্ধকার থেকে হিদায়াতের আলো চান, অথবা অন্তরের কঠোরতা দূর করে আধ্যাত্মিক প্রশান্তি লাভ করতে চান।

এখন আমরা নবীজি (ﷺ)-এর শেখানো নূর বৃদ্ধির একটি বিশেষ দোয়া উল্লেখ করব, যা আমাদের জীবনে আধ্যাত্মিক ও বাহ্যিক আলো বৃদ্ধি করতে সহায়ক হবে।

নূর (نور) কী?

নূর শব্দটি আরবি ভাষার একটি গুরুত্বপূর্ণ শব্দ, যার অর্থ আলো, জ্যোতি বা দীপ্তি। এটি কুরআন ও হাদিসে বিভিন্ন প্রসঙ্গে ব্যবহৃত হয়েছে এবং ইসলামিক বিশ্বাস অনুযায়ী একাধিক অর্থ বহন করে।

নূরের বিভিন্ন তাৎপর্য

আল্লাহর এক গুণবাচক নাম: আল্লাহ তাআলা নিজেই নূর: কুরআনে এসেছে—

اللَّهُ نُورُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ

“আল্লাহ আসমানসমূহ ও জমিনের নূর।” (সুরা নূর: ৩৫)

এখানে নূর বলতে আল্লাহর গুণ বোঝানো হয়েছে, অর্থাৎ তিনি সৃষ্টি জগতের আলো ও পথপ্রদর্শক।

হেদায়াত বা সত্যের আলো: ইসলাম ও কুরআনকে নূর বলা হয়েছে কারণ এটি মানুষকে সত্যের পথে পরিচালিত করে। যেমন, আল্লাহ বলেন:

وَلَكِنْ جَعَلْنَاهُ نُورًا نَهْدِي بِهِ مَنْ نَشَاءُ مِنْ عِبَادِنَا

“বরং আমি এটিকে (কুরআনকে) নূর করেছি, যার দ্বারা আমি আমার বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা পথ প্রদর্শন করি।” (সুরা শুরা: ৫২)

নবী মুহাম্মাদ (ﷺ) কে নূর বলা হয়েছে: অনেক ইসলামী স্কলার মনে করেন, নবী করিম (ﷺ) নূর অর্থাৎ আলোর প্রতীক, কারণ তিনি মানবতার জন্য পথপ্রদর্শক হয়ে এসেছেন। যেমন, কুরআনে বলা হয়েছে:

قَدْ جَاءَكُمْ مِنَ اللَّهِ نُورٌ وَكِتَابٌ مُبِينٌ

“তোমাদের কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে এক নূর ও স্পষ্ট কিতাব এসেছে।” (সুরা মায়েদা: ১৫)

মুমিনদের জন্য কিয়ামতের দিন নূর: কিয়ামতের দিন মুমিনদের জন্য নূর থাকবে, যা তাদের সামনে ও ডানে থাকবে।

يَوْمَ تَرَى الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ يَسْعَىٰ نُورُهُم بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَبِأَيْمَانِهِم

“সেদিন তুমি দেখবে, মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদের নূর তাদের সামনে ও ডান দিকে ছুটে চলবে।” (সুরা হাদীদ: ১২)

নূর বৃদ্ধির দোয়া

নূর বৃদ্ধির জন্য নবী মুহাম্মাদ ﷺ যে দোয়া পড়তেন, তা হাদিসে পাওয়া যায়। এই দোয়াটি বিশেষভাবে ফজরের সুন্নত নামাজের পর বা অন্য সময় পড়া যায়।

১. সংক্ষিপ্ত দোয়া

اللَّهُمَّ اجْعَلْ فِي قَلْبِي نُورًا

উচ্চারণ:

اللهم اجعل في قلبي نورا

অর্থ: হে আল্লাহ, আমার অন্তরে নূর দান করুন।

২. সম্পূর্ণ দোয়া:

اللَّهُمَّ اجْعَلْ فِي قَلْبِي نُورًا، وَفِي بَصَرِي نُورًا، وَفِي سَمْعِي نُورًا، وَعَنْ يَمِينِي نُورًا، وَعَنْ يَسَارِي نُورًا، وَفَوْقِي نُورًا، وَتَحْتِي نُورًا، وَأَمَامِي نُورًا، وَخَلْفِي نُورًا، وَاجْعَلْ لِي نُورًا

উচ্চারণ: Allahumma aj‘al fī qalbī nūrā, wa fī basarī nūrā, wa fī sam‘ī nūrā, wa ‘an yamīnī nūrā, wa ‘an yasārī nūrā, wa fawqī nūrā, wa taḥtī nūrā, wa amāmī nūrā, wa khalfī nūrā, waj‘al lī nūrā.

অর্থ: হে আল্লাহ, আমার অন্তরে নূর দান করুন, আমার দৃষ্টিতে নূর দান করুন, আমার শ্রবণে নূর দান করুন, আমার ডান পাশে নূর দান করুন, আমার বাম পাশে নূর দান করুন, আমার ওপর নূর দান করুন, আমার নিচে নূর দান করুন, আমার সামনে নূর দান করুন, আমার পেছনে নূর দান করুন, এবং আমার জন্য নূর করে দিন। (সহিহ বুখারি: ৬৩১৬, সহিহ মুসলিম: ৭৬৩)

ফজিলত

  • এই দোয়া রাসুলুল্লাহ ﷺ ফজরের নামাজের সুন্নাতের পর পড়তেন।
  • এটি আল্লাহর কাছ থেকে হেদায়াত, আত্মিক আলো ও প্রশান্তি লাভের মাধ্যম।
  • দোয়াটি হৃদয়ে ঈমানের আলো বৃদ্ধি করে, যা পথভ্রষ্টতা থেকে বাঁচায়।

নূর বৃদ্ধির দোয়া কখন পড়া উত্তম?

নূর বৃদ্ধির দোয়া পড়ার নির্দিষ্ট সময়ের ব্যাপারে হাদিসে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই, তবে কিছু বিশেষ সময় ও পরিস্থিতিতে এই দোয়া পড়লে অধিক উপকারী হতে পারে। নিম্নে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সময় উল্লেখ করা হলো—

  • সুবহে সাদিক ও ফজরের পরে : ফজরের সময় হলো বরকতময় একটি সময়, যখন আল্লাহর নূর ও রহমত ব্যাপকভাবে অবতীর্ণ হয়। এ সময় নূর বৃদ্ধির দোয়া পড়লে পুরো দিনের জন্য আধ্যাত্মিক আলো ও হিদায়াত লাভ করা সহজ হয়।
  • নামাজের পর: বিশেষত তাহাজ্জুদ, ফজর, ও মাগরিবের নামাজের পর এই দোয়া পড়া খুবই ফলপ্রসূ হতে পারে, কারণ এ সময় দোয়া কবুল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
  • ইলম অর্জনের আগে ও পরে: কুরআন তিলাওয়াত, হাদিস পড়া, ইসলামী জ্ঞান অর্জন বা শিক্ষা দেওয়ার আগে ও পরে নূর বৃদ্ধির দোয়া করলে আল্লাহর পক্ষ থেকে অন্তরে সত্য বোঝার ও গ্রহণ করার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
  • অন্ধকারাচ্ছন্ন মন ও অন্তরের কঠোরতা অনুভব করলে: যদি কখনো মনে হয় যে অন্তর কঠোর হয়ে গেছে, ইবাদতে মনোযোগ আসছে না, গুনাহের প্রতি আকর্ষণ বাড়ছে—তখন নূর বৃদ্ধির দোয়া করলে হৃদয়ের অন্ধকার দূর হয়ে আধ্যাত্মিক প্রশান্তি আসবে।
  • মসজিদে প্রবেশ ও বের হওয়ার সময়: মসজিদে প্রবেশের সময় আল্লাহর নূরের বরকত লাভের জন্য এই দোয়া পড়া উত্তম।
  • কবর জিয়ারতের সময়: কবর জিয়ারতের সময় নিজের ও সকল মুসলিমের কবরকে নূরে আলোকিত করার জন্য দোয়া করা যেতে পারে।
  • রাতের শেষ তৃতীয়াংশে (তাহাজ্জুদের সময়): এ সময় দোয়া কবুল হওয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত।
  • পবিত্র রাত ও দিনসমূহে: শবে কদর, শবে মেরাজ, শবে বরাত, আরাফার দিন, জুমার দিন ইত্যাদি সময়ে নূর বৃদ্ধির দোয়া করলে বিশেষ ফজিলত পাওয়া যায়।

আরো পড়ুন:

উপসংহার

নূর বৃদ্ধির দোয়া শুধু বাহ্যিক সৌন্দর্য নয়, বরং ঈমানের আলো, হিদায়াতের দৃঢ়তা ও আত্মার প্রশান্তি লাভের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের জন্য সত্যের পথ উন্মুক্ত করে দেন এবং যাদের অন্তরে নূর দান করেন, তাদের জন্য সঠিক পথচলা সহজ করে দেন।

নবীজি (ﷺ) বিভিন্ন দোয়ায় আল্লাহর কাছে নূর বৃদ্ধির আবেদন করেছেন, যা আমাদের শেখায় যে, সত্য, জ্ঞান ও সৎ আমলের মাধ্যমে আমরা আল্লাহর নূর অর্জন করতে পারি। এই দোয়াগুলো নিয়মিত পড়লে আমাদের হৃদয় আলোকিত হবে, চিন্তা-চেতনায় স্বচ্ছতা আসবে এবং দুনিয়া ও আখিরাতে আল্লাহর রহমত লাভের পথ সুগম হবে।

আসুন, আমরা এই দোয়াগুলো আমাদের জীবনের অংশ বানাই এবং আল্লাহর কাছে তাঁর নূর ও হিদায়াতের জন্য বিনীত প্রার্থনা করি। আল্লাহ আমাদের সবাইকে তাঁর নূরের আলোতে আলোকিত করুন—আমিন!


পোস্টটি শেয়ার করুন