বাস্তব জীবনের কষ্টের গল্প । ১২ টি দুঃখ, সংগ্রাম ও সহনশীলতার কাহিনী

Share this post

মানুষের জীবন সবসময় সমান নয়। কারও শৈশব কাটে সুখ-সমৃদ্ধিতে, আবার কারও শৈশব শুরু হয় অভাব আর দুঃখ-কষ্ট দিয়ে। কেউ সামান্য একটি সমস্যায় হাল ছেড়ে দেয়, আবার কেউ পাহাড়সম কষ্ট বুকে নিয়েও লড়ে যায়। আমাদের সমাজে অসংখ্য মানুষ আছে— যাদের গল্পগুলো হয়তো কখনও আলোচনায় আসে না, তারা চুপচাপ নিজের যন্ত্রণা বয়ে বেড়ায়।

এই গল্পগুলো আসলে কেবল এক ব্যক্তির নয়, এগুলো আমাদের সমাজের প্রতিচ্ছবি। একেকজন মানুষের দুঃখের কাহিনি আমাদের শেখায়— জীবন কতটা নির্মম হতে পারে, আর মানুষ কতটা সহ্য করতে পারে।

বাস্তব জীবনের এসব কষ্টের গল্প হয়তো পাঠকের চোখে অশ্রু আনবে, তবে একই সাথে একটি শিক্ষা দেবে—অভাব, দুঃখ আর যন্ত্রণা সত্ত্বেও মানুষ বেঁচে থাকে, কারণ আশাই তাকে বাঁচিয়ে রাখে।

বাস্তব জীবনের কষ্টের গল্প ১ । হোসেনের জীবনের হিসাব

ঢাকার উপকণ্ঠে এক ছোট্ট ভাঙা ঘরে থাকে হোসেন। বয়স ৩৯ বছর। দেখতে শুকনো, রোদে পোড়া, হাতের আঙুলগুলোতে শক্ত চামড়া জমে গেছে। তার চোখে এক ধরনের শূন্যতা, যা অনেক বছরের কষ্ট আর অপূর্ণ স্বপ্নের গল্প বলে দেয়।

হোসেন জন্মেছিল কুমিল্লার এক গ্রামে। বাবা ছিলেন দিনমজুর। মাটির ঘর, খড়ের চাল, সামনে ছোট্ট পুকুর আর কাঁচা রাস্তা—এগুলোই ছিল শৈশবের দৃশ্য। বাবা যখন মাঠে কাজ করতেন, মা অন্যের বাড়িতে ঝি-ঝামেলার কাজ করতেন। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে হোসেন ছিল সবচেয়ে বড়। সবার মুখে অন্ন জোটাতে গিয়ে বাবার শরীর খুব দ্রুত ভেঙে পড়ল।

একদিন বিকেলে বাবা মাঠ থেকে ফিরেই হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন। গ্রামের ডাক্তার বলল—“হার্টে সমস্যা। শহরে নিতে হবে।” কিন্তু শহরে নেওয়ার মতো টাকা কোথায়? সেদিন মা কেঁদে উঠেছিল—
“আমার স্বামীর জীবনটাও কি টাকার কাছে হেরে যাবে?”

কিন্তু সত্যি তাই হলো। চিকিৎসা না পাওয়ায় এক রাতেই বাবা পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন। সেই সময় হোসেনের বয়স মাত্র ১৫।

কষ্টের শুরু

বাবা মারা যাওয়ার পর ঘরে অভাব আরও প্রকট হয়ে গেল। স্কুলের বইয়ের খরচ, ছোট ভাইবোনদের খাওয়া, ঘরের চালচুলো—সবকিছু যেন থেমে গেল। হোসেন তখন ক্লাস নাইন-এ পড়ে। পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার মতো সামর্থ্য তার আর রইল না। একদিন স্কুলের শিক্ষক যখন বকাঝকা করলেন টিফি (ফি) না দেওয়ার জন্য, তখন হোসেন লজ্জায় মাথা নিচু করে স্কুল ছাড়ল।

সেই থেকে শুরু হলো তার জীবনের আসল সংগ্রাম।

প্রথমে গ্রামে দিনমজুরের কাজ করত। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত খেতে না খেয়ে মাটি কাটত, রোদে পুড়ে যেত। মজুরি পেত দিনে ৫০ টাকা। সেই টাকা দিয়ে পাঁচজনের মুখে খাবার তুলে দেওয়া যায় না। মা রাতে ভাতের সাথে নুন-মরিচ খেয়ে দিন কাটাতেন, আর হোসেন ভাইবোনদের জন্য নিজের ভাগের ভাত ছেড়ে দিত।

শহরে পাড়ি

একদিন গ্রামের এক আত্মীয় বলল—
“ঢাকায় গেলে কাজ পাওয়া যাবে। হেলপার কিংবা ফ্যাক্টরির কাজ করলে টাকাও বেশি।”

মায়ের চোখে পানি এসে গেলেও হোসেন সিদ্ধান্ত নিল ঢাকায় যাবে। মাত্র ২০০ টাকা নিয়ে ট্রেনে চেপে চলে এল ঢাকায়। প্রথম কদিন থাকল কমলাপুর স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে। ক্ষুধার্ত অবস্থায় ঠেলাগাড়ি ঠেলল, কখনও রিকশা চালাল। কিন্তু শহরের জীবন এত সহজ ছিল না। অনেক সময় কাজের মালিকরা টাকা না দিয়েই তাড়িয়ে দিত।

একদিন ক্ষুধার তাড়নায় হোসেন কান্না করে ফেলল। মনে হচ্ছিল—“বাবা থাকলে হয়তো আমাকে এই পথে আসতে হতো না।”

বিয়ে ও নতুন সংগ্রাম

কয়েক বছর পর হোসেন একটু স্থিত হলো। গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কাজ পেল। বেতন মাত্র ৪৫০০ টাকা। এই টাকা দিয়ে মাকে আর ভাইবোনদের সাহায্য করত। কিন্তু দিন দিন খরচ বাড়ছিল, টানাপোড়েন বেড়ে যাচ্ছিল।

এর মাঝেই হোসেনের বিয়ে হলো। বউয়ের নাম শিরিন। বিয়ে করার পর মনে হলো, হয়তো সুখের দিন শুরু হবে। কিন্তু সুখের বদলে বোঝা আরও বাড়ল। ভাড়া বাসা, বাজার খরচ, মায়ের চিকিৎসা—সব মিলিয়ে তার কপালে যেন আরেক স্তরের দুঃখ জমা হলো।

এক বছরের মাথায় তাদের ঘরে একটি ছেলে জন্ম নিল। নাম রাখা হলো সাব্বির। ছেলেকে দেখে হোসেনের মনে আশার আলো জ্বলে উঠেছিল। কিন্তু সন্তান মানেই নতুন খরচ। দুধ, ওষুধ, ডাক্তারের ভিজিট—সবকিছু সামলাতে গিয়ে হোসেনের কপালে চিন্তার ভাঁজ আরও গভীর হলো।

জীবনের নির্মম বাস্তবতা

গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কাজ করার সময় হোসেনের হাত মেশিনে আটকে গিয়ে আঙুল কেটে যায়। কয়েকদিন চিকিৎসা করাতে হলো। এই সময় বেতনও বন্ধ হয়ে গেল। ঋণ করতে হলো বাড়িওয়ালা, দোকানদার, এমনকি অফিসের সহকর্মীদের কাছ থেকে।

শিরিন অনেক সময় কেঁদে বলত—
“এই জীবনে কি আমরা কখনও স্বস্তি পাবো না?”

হোসেন চুপ করে থাকত। উত্তর দেবার মতো শব্দ খুঁজে পেত না।

মায়ের মৃত্যু

কিছুদিন পর হোসেনের মা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। ডাক্তার বলল—কিডনির সমস্যা, নিয়মিত ডায়ালাইসিস করতে হবে। হোসেন জানত, এত টাকা তার পক্ষে সম্ভব নয়। তবুও প্রাণপণে চেষ্টা করল। এক আত্মীয়ের কাছে টাকা ধার নিল, কিছু বন্ধু সাহায্য করল। কিন্তু দীর্ঘদিন টিকিয়ে রাখা সম্ভব হলো না।

একদিন গভীর রাতে খবর এলো—মা নেই।
হোসেন যেন ভেঙে পড়ল। মাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল—“তোমাকে সুস্থ করব।” কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারল না। মায়ের লাশের পাশে বসে সে শুধু বলেছিল—
“আমার সব চেষ্টাই ব্যর্থ হলো মা।”

ছেলের অসুস্থতা

মায়ের মৃত্যুর কষ্ট কাটিয়ে ওঠার আগেই আরেক ঝড় এলো। ছোট ছেলে সাব্বির হঠাৎ জ্বরে ভুগতে শুরু করল। ডাক্তার বলল—টাইফয়েড। চিকিৎসার খরচ মেটানো হোসেনের পক্ষে সম্ভব ছিল না। কয়েকদিন ওষুধ না পেয়ে ছেলেটা দুর্বল হয়ে পড়ল। হোসেন প্রতিদিন রিকশা চালিয়ে যতটুকু আয় করত, তার অর্ধেক ওষুধে চলে যেত।

এক রাতে শিরিন কাঁদতে কাঁদতে বলল—
“আমরা কেন এভাবে বেঁচে আছি? আল্লাহ আমাদের জন্য কোনো ভালো দিন রাখেননি?”

হোসেন শুধু তাকিয়ে রইল আকাশের দিকে। উত্তর তার কাছেও নেই।

ভাঙা স্বপ্ন

আজ হোসেনের বয়স প্রায় ৪০। শরীর ভেঙে পড়ছে, রিকশা চালাতে আর আগের মতো শক্তি পাচ্ছে না। ভাড়া বাসার দেয়াল ফেটে যাচ্ছে, ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করানোর মতো টাকা নেই। মাঝে মাঝে রাতে কাজ শেষে রাস্তায় বসে থাকে, চোখে অশ্রু জমে যায়। মনে মনে ভাবে—

“আমি যদি পড়াশোনা শেষ করতে পারতাম, হয়তো আজ এই জীবন হতো না।”

কিন্তু বাস্তবতা হলো, সেই সুযোগ সে কখনও পায়নি।

সমাজের প্রতিচ্ছবি

হোসেনের গল্প শুধু হোসেনের নয়। বাংলাদেশের হাজারো দরিদ্র মানুষের গল্প এটি। যারা জন্ম থেকেই সংগ্রামের মধ্যে বেঁচে থাকে, শিক্ষা-চিকিৎসা-খাবারের জন্য যুদ্ধ করে, আর স্বপ্নগুলো একে একে হারিয়ে ফেলে।

উপসংহার

হোসেনের জীবন আজও কষ্টে ঘেরা। হয়তো একদিন তার ছেলেই তাকে একটু সুখ দেবে, হয়তো কখনও তা-ও হবে না। কিন্তু তার জীবন আমাদের শেখায়—

দারিদ্র্য শুধু অভাব নয়, দারিদ্র্য হলো এক অন্তহীন যন্ত্রণা, যা মানুষের স্বপ্ন, ভালোবাসা আর আশা সবকিছুকে ধীরে ধীরে নিঃশেষ করে দেয়।

বাস্তব জীবনের কষ্টের গল্প চিত্র ১
বাস্তব জীবনের কষ্টের গল্প চিত্র ১

বাস্তব জীবনের কষ্টের গল্প ২ । রুবিনার ভাঙা স্বপ্ন

বরিশালের এক প্রত্যন্ত গ্রামে জন্ম রুবিনার। বয়স এখন ২৮। কিন্তু তার চোখে বয়সের তুলনায় অনেক বেশি ক্লান্তি আর অস্থিরতা জমে আছে। ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল—সে বড় হয়ে শিক্ষক হবে। ছোট ছোট শিশুদের পড়াবে, বইয়ের গন্ধে ভরা এক শান্ত জীবনে থাকবে।

কিন্তু বাস্তব জীবনের কষ্ট তার সেই স্বপ্নকে কেবল ভেঙেই দেয়নি, প্রতিদিন নতুন নতুন যন্ত্রণা যোগ করেছে।

শৈশবের দরিদ্রতা

রুবিনার বাবা ছিলেন একজন ক্ষুদ্র কৃষক। দুই বিঘা জমি নিয়ে সংসার চালাতেন। বৃষ্টি হলে ফসল নষ্ট, খরা হলে জমি শুকিয়ে যেত। মা ছিলেন গৃহিণী, তবে সংসারের অভাব মেটাতে অন্যের বাড়িতে কাজও করতেন।

পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে রুবিনা ছিল দ্বিতীয়। ছোটবেলা থেকেই অভাব ছিল তার সঙ্গী। অনেক সময় স্কুলে যেতে হতো খালি পায়ে। টিফিনে অন্যরা যখন বিস্কুট, সমুচা বা ডালপুরি খেত, রুবিনা শুধু পানি খেয়ে বসে থাকত।

তবুও সে পড়াশোনায় ভালো ছিল। প্রতিবার ক্লাসে প্রথম হতো। শিক্ষকরা বলতেন—
“এই মেয়েটার চোখে আলোর ঝলক আছে। একদিন মানুষ হবে।”

কিন্তু সে আলো খুব দ্রুত অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।

শিক্ষাজীবনের বাধা

এসএসসি পরীক্ষার সময় বাবার অসুস্থতা শুরু হলো। হঠাৎ করে কিডনির সমস্যা ধরা পড়ল। চিকিৎসার জন্য টাকা দরকার ছিল। রুবিনার মায়ের কাছে কোনো উপায় ছিল না। গ্রামের বাড়ি বন্ধক রেখে ধার করতে হলো।

পরীক্ষা শেষ হলো, কিন্তু বাবাকে আর বাঁচানো গেল না। বাবা মারা গেলেন। সেই দিন থেকে রুবিনার পড়াশোনা প্রায় থেমে গেল।

মা বললেন—

“মেয়ে, তুই তো এখন বড়। ভাইবোনদের দেখাশোনার দায়িত্ব নিতে হবে। পড়াশোনা করে কী হবে? খেতে তো দিতে হবে।”

রুবিনার বুক ভেঙে গেল। চোখের পানি চেপে ধরে বলল— “মা, আমি শিক্ষক হতে চাই। অন্তত এইচএসসি পর্যন্ত পড়তে দাও।”

মা কেঁদে সম্মতি দিলেন। কিন্তু খরচের বোঝা ছিল পাহাড়সমান। বই কিনতে পারত না, কোচিং করা তো দূরের কথা। অনেক সময় টিউশন ফি বাকি থাকত। তবুও রুবিনা নিজের চেষ্টা দিয়ে এইচএসসি পাস করল।

কিন্তু এর পর আর পড়ার সুযোগ পেল না।

বিয়ের চাপ

২০ বছর বয়সে গ্রামের আত্মীয়স্বজনরা চাপ দিতে শুরু করল—

“মেয়ের বয়স হয়ে গেছে, বিয়ে দিয়ে দাও।”

মা বাধ্য হয়ে এক দিনমজুর পরিবারের ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিলেন। ছেলেটির নাম ফরিদ। প্রথমদিকে রুবিনা ভেবেছিল, হয়তো নতুন জীবনে কিছুটা সুখ পাবে।

কিন্তু সুখ আসেনি। ফরিদ ছিল রাগী ও মদ্যপ। কাজ থেকে ফিরেই মদের নেশায় ডুবে যেত। সামান্য কারণে গায়ে হাত তুলত।

রুবিনা প্রথমে সহ্য করত। ভেবেছিল—“হয়তো বদলে যাবে।” কিন্তু সময়ের সাথে সাথে অত্যাচার আরও বেড়ে গেল।

সন্তানের জন্ম ও নতুন কষ্ট

বিয়ের তিন বছরের মাথায় রুবিনার একটি মেয়ে সন্তান জন্ম নিল। নাম রাখা হলো নাহিদা। মেয়ে দেখে রুবিনা কিছুটা সান্ত্বনা পেল। কিন্তু সংসারের ঝড় থামল না।

ফরিদ তখন প্রায়ই বলত—

“ছেলে না হয়ে মেয়ে হলো কেন? মেয়ের আবার কী দাম আছে?”

এই কথাগুলো রুবিনার হৃদয়ে ছুরি হয়ে বিঁধত। তবুও সন্তানের জন্য সব সহ্য করত।

একদিন রাতে ফরিদ মাতাল হয়ে এসে রুবিনাকে প্রচণ্ড মারল। কারণ—চাল ফুরিয়ে গেছে, খাবার রান্না হয়নি। রুবিনা তখন অসুস্থ ছিল, তবুও সেই ব্যথা লুকিয়ে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে রাখল।

সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি

রুবিনা অনেক সময় ভেবেছে, সংসার ছেড়ে চলে যাবে। কিন্তু সমাজ তাকে সুযোগ দেয়নি। গ্রামে বিধবা বা তালাকপ্রাপ্তা নারী মানেই অন্যের চোখে বোঝা। মা-ও বলতেন—

“বিয়ে টিকিয়ে রাখ মেয়ে, সমাজে মুখ দেখাতে হবে।”

তাই সব যন্ত্রণা সহ্য করে বেঁচে থাকতে হয়েছে।

মেয়ের অসুস্থতা

যখন নাহিদার বয়স পাঁচ বছর, হঠাৎ করে গুরুতর অসুস্থ হলো। ডাক্তার বলল—হৃদরোগ। চিকিৎসার জন্য প্রচুর টাকা দরকার। রুবিনার হৃদয় কেঁপে উঠল।

ফরিদ দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করল। উল্টো বলল—

“মেয়ের চিকিৎসায় টাকা খরচ করার মতো সামর্থ্য নেই। মরলে মরুক।”

রুবিনা তীব্র প্রতিবাদ করল। নিজের কানের দুল বিক্রি করল, মানুষের বাড়িতে কাজ করল, গ্রামে গিয়ে কেঁদে কেঁদে সাহায্য চাইল। তবুও পুরো চিকিৎসার খরচ জোগাড় করতে পারল না।

অবশেষে ছোট্ট নাহিদা পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল।

সন্তানের লাশ বুকে নিয়ে রুবিনা ভেঙে পড়ল। মনে হলো—জীবনে তার আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।

আজকের রুবিনা

এখন রুবিনা ২৮ বছরের এক বিধ্বস্ত নারী। ফরিদ তাকে ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে। সে এখন মানুষের বাড়িতে ঝি-ঝামেলার কাজ করে। মাসে ৬-৭ হাজার টাকা আয় হয়, যা দিয়ে নিজের ভাড়া বাসা চালায়।

প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করে শরীর ভেঙে যাচ্ছে। তবুও মুখে হাসি ধরে রাখে। কারণ সে জানে—অভিযোগ করলে কেউ শুনবে না।

তার চোখে এখনও এক স্বপ্ন রয়ে গেছে—

“কোনো একদিন যদি সামর্থ্য হয়, আমি গ্রামের দরিদ্র শিশুদের পড়াব। আমি তো হতে পারিনি, অন্তত অন্যদের স্বপ্ন পূরণে একটু পাশে থাকব।”

সমাজের প্রতিচ্ছবি

রুবিনার গল্প আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়—

  • দারিদ্র্য একজন মেধাবী মেয়ের স্বপ্ন কিভাবে ভেঙে দেয়।
  • বিয়ে নামক সামাজিক চাপ কিভাবে নারীদের জীবনে বিষ ঢেলে দেয়।
  • সন্তানের মৃত্যু কিভাবে একজন মায়ের হৃদয় চূর্ণ করে দেয়।

এ গল্প শুধু রুবিনার নয়, হাজারো নারীর গল্প। যারা নীরবে বাঁচে, নীরবে কাঁদে, আর সমাজের চোখে অদৃশ্য হয়ে যায়।

উপসংহার

রুবিনার জীবন আমাদের শেখায়—
কষ্ট মানুষকে ভেঙে দেয়, আবার শক্তিও দেয়।

সে ভেঙে পড়েছে, হারিয়েছে স্বপ্ন, হারিয়েছে সন্তান। তবুও বেঁচে আছে, অন্যের ঘরে কাজ করে হলেও নিজের মর্যাদা ধরে রেখেছে।

এটি আমাদের সমাজের এক বাস্তব আয়না, যেখানে স্বপ্নগুলো অভাবে মরে যায়, অথচ মানুষগুলো বেঁচে থাকে—শুধু টিকে থাকার জন্য।

বাস্তব জীবনের কষ্টের গল্প চিত্র ২
বাস্তব জীবনের কষ্টের গল্প চিত্র ২

বাস্তব জীবনের কষ্টের গল্প ৩ । আজিজ মিয়ার শেষ ভরসা

আজিজ মিয়া বয়সে এখন ৬৫। চুল সাদা, শরীর শুকনো, পিঠ বাঁকা হয়ে গেছে। গ্রামে তাকে সবাই “আজিজ চাচা” বলে ডাকে। এক সময় ছিলেন শক্তপোক্ত মানুষ। দিনে মাঠে লাঙল ধরতেন, রাতে খড়ের চালের নিচে সন্তানদের সাথে গল্প করতেন।

আজ তার দিন কাটে এক ভাঙা কুঁড়েঘরে, হাতে লাঠি, চোখে জল আর বুকভরা হাহাকার নিয়ে।

তারুণ্যের দিন

আজিজ মিয়া ছোটবেলায় খুব কষ্টেই বড় হয়েছেন। বাবা ছিলেন গরিব কৃষক। পরিবারে ৮ ভাইবোন, সবার খাওয়া-দাওয়া জোটানোই ছিল বড় যুদ্ধ। ছোটবেলা থেকেই জমিতে কাজ করতেন। পড়াশোনা হয়নি।

কঠিন পরিশ্রমে একসময় সামান্য কিছু জমি কিনতে পেরেছিলেন। নিজের ঘর বানালেন। মনে হলো—“এবার সংসার কিছুটা শান্তিতে চলবে।”

তখনই তার বিয়ে হলো। বউয়ের নাম ছিল রহিমা। সাদাসিধে, শান্ত মেয়ে। দুজনের দাম্পত্য জীবন শুরু হলো অনেক কষ্টের মধ্যে, কিন্তু ভালোবাসায় ভরা।

সন্তানদের জন্য জীবন

এক এক করে তিন ছেলে আর দুই মেয়ে হলো। সন্তানদের মুখে ভাত তুলে দেওয়ার জন্য আজিজ মিয়া নিজের শরীরকে অবহেলা করে দিনরাত খেটে যেতেন।

মাটি কেটে, ধান কেটে, বাজারে দিনমজুর হয়ে—সব কাজ করতেন।

তার স্বপ্ন ছিল—
“আমার ছেলেরা পড়াশোনা শিখে মানুষ হবে, তারা আর আমার মতো মাটির সাথে মিশে থাকবে না।”

এই স্বপ্নের জন্য তিনি নিজের শরীরকে অমানুষিক কষ্ট দিয়েছেন। ছেলেদের স্কুলে ভর্তি করালেন। মেয়েদেরও পড়াশোনা করালেন, যদিও অনেকেই বলেছিল—“মেয়েদের পড়াশোনার দরকার কী?”

আজিজ মিয়া তখন বলতেন—
“মেয়ে-ছেলে আলাদা নয়। সবাই মানুষ। সবাইকে শিক্ষিত হতে হবে।”

ভাগ্যের নির্মম খেলা

কিন্তু জীবনে সুখ বেশিদিন টেকে না। প্রথম আঘাত এলো যখন রহিমা অসুস্থ হয়ে পড়ল। দীর্ঘদিন ধরে কিডনির সমস্যায় ভুগছিলেন। চিকিৎসা দরকার ছিল নিয়মিত।

কিন্তু দরিদ্র আজিজের কাছে সেই টাকার ব্যবস্থা ছিল না। সব জমি বিক্রি করে দিলেন, চিকিৎসা করালেন। তবুও স্ত্রীকে বাঁচাতে পারলেন না।

স্ত্রী মারা যাওয়ার পর আজিজ ভেঙে পড়লেন। কিন্তু সন্তানদের কথা ভেবে দাঁড়িয়ে গেলেন। মনে করলেন—“ওরাই আমার ভরসা।”

সন্তানদের ভিন্ন জীবন

সময় গড়িয়ে গেল। ছেলেরা বড় হলো। একে একে শহরে চলে গেল। চাকরি বা ব্যবসা করল। মেয়েদের বিয়ে দেওয়া হলো।

আজিজ ভেবেছিলেন—এবার হয়তো কষ্ট কমবে। ছেলেরা তাকে দেখাশোনা করবে।

কিন্তু হলো উল্টো।

প্রথম ছেলে বিদেশে গেল। খুব কমই ফোন দিত। টাকা পাঠাত না।
দ্বিতীয় ছেলে ঢাকায় চাকরি পেল। বউ-সন্তান নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
তৃতীয় ছেলে ছোটখাটো ব্যবসা শুরু করল, কিন্তু বাবার খোঁজ নেওয়ার সময় পেল না।

মেয়েরা মাঝে মাঝে আসত, কিন্তু তাদেরও সংসারের টানাপোড়েন ছিল।

নিঃসঙ্গতা ও উপেক্ষা

আজিজ এখন একা। বয়স হয়েছে, কাজ করতে পারেন না। ভোরে লাঠি নিয়ে বাজারে যান, কারও দোকানের সামনে বসে থাকেন। যদি একটু ভাত বা টাকা দেয়।

পাড়া-প্রতিবেশীরা অনেক সময় দয়া করে কিছু খাবার দেয়। কিন্তু ছেলেরা কেউ আসে না।

একদিন গ্রামের মসজিদের ইমাম তাকে জিজ্ঞেস করলেন—
“চাচা, আপনার ছেলেরা কি আপনাকে দেখতে আসে না?”

আজিজ চুপ করে ছিলেন কিছুক্ষণ। তারপর চোখের পানি মুছে বললেন—
“ওরা এখন বড় মানুষ। তাদের সময় নেই।”

এক ঝড়ের রাত

একবার প্রবল ঝড়ে আজিজের ভাঙা কুঁড়েঘরের চাল উড়ে গেল। রাতভর বৃষ্টি হলো। ভেতরে পানি জমে সব ভিজে গেল।

সে রাতে আজিজ ভিজে শরীর নিয়ে বসে ছিলেন। বুকের ভেতর শুধু একটা প্রশ্ন ঘুরছিল—
“আমি কি এই ছেলেদের মানুষ করার জন্য এত কষ্ট করেছি?”

গ্রামের মানুষ

গ্রামের মানুষ মাঝে মাঝে সাহায্য করে। কেউ চাল দেয়, কেউ পুরোনো কাপড়। কিন্তু আজিজের মনে সবসময় এক শূন্যতা রয়ে গেছে।

কারণ, বাবা-মা সন্তানের কাছে শুধু খাবার বা টাকার আশায় থাকে না। তারা চায় স্নেহ, ভালোবাসা, খোঁজখবর। সেটা আজিজ পাননি।

আজকের চিত্র

আজিজ এখন বার্ধক্যের শেষ প্রান্তে। প্রতিদিন মসজিদের সামনে বসে নামাজ পড়ে, মানুষের সাথে একটু কথা বলে।

কেউ যদি জিজ্ঞেস করে—“চাচা, আপনার ছেলেরা কী করছে?”
তখন তিনি কষ্ট চেপে মুখে শুধু হাসেন। বলেন—

“ওরা সবাই ভালো আছে, আল্লাহ তাদের সুখে রাখুন।”

কিন্তু রাতের অন্ধকারে একা বসে কাঁদেন। মনে মনে বলেন— “আমি হয়তো কোনো ভুল করেছিলাম। তাই ছেলেরা আমাকে ভুলে গেছে।”

সমাজের প্রতিচ্ছবি

আজিজ মিয়ার গল্প নতুন নয়। গ্রামে-শহরে হাজারো বাবা-মা আছেন, যারা সন্তানদের জন্য জীবন ভেঙে দেন। কিন্তু সন্তান বড় হয়ে বাবা-মাকে ভুলে যায়।এটি শুধু এক ব্যক্তির গল্প নয়, এটি আমাদের সমাজের এক করুণ বাস্তবতা।

বাস্তব জীবনের কষ্টের গল্প চিত্র ৩
বাস্তব জীবনের কষ্টের গল্প চিত্র ৩

উপসংহার

আজিজ মিয়ার জীবন শেখায়—

সব সন্তান বাবা-মায়ের কষ্ট বোঝে না। কেউ কেউ ভুলে যায়, উপেক্ষা করে। কিন্তু এই অবহেলা শুধু একজন বৃদ্ধ বাবার হৃদয় ভাঙে না, বরং আমাদের মানবিকতার আয়নাকেও ভেঙে দেয়।

আজিজের মতো অসংখ্য মানুষ আছে, যারা হয়তো শুধু একবার ছেলেমেয়ের স্নেহমাখা স্পর্শ চায়। অথচ তারা তা পায় না।


Share this post
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x