ভালোবাসা মানুষের জীবনের অন্যতম গভীর অনুভূতি। যখন কোনো প্রিয় মানুষ আমাদের থেকে দূরে সরে যায়, তখন হৃদয়ে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়, তা সহ্য করা সত্যিই কঠিন। বিশেষ করে যদি সেই মানুষটি হয় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ—বাগদত্তা, স্বামী-স্ত্রী, বা এমন কেউ যার সাথে ভবিষ্যতের স্বপ্ন বোনা হয়েছিল। ইসলামে দুঃখ-কষ্টের সময় আল্লাহর দিকে ফিরে যাওয়াকে সবচেয়ে উত্তম সমাধান বলা হয়েছে। কারণ তিনিই হৃদয়ের নিয়ন্ত্রক, তিনিই মানুষের মনে ভালোবাসা সৃষ্টি করেন এবং মিলনের ব্যবস্থা করে দেন। ভালোবাসার মানুষকে ফিরে পাওয়ার জন্য দোয়া করা মানে অন্ধভাবে কিছু দাবি করা নয়।
বরং আল্লাহর কাছে খাঁটি হৃদয়ে প্রার্থনা করা। যেন তিনি আমাদের জন্য যা কল্যাণকর, সেটিই আমাদের জীবনে ঘটিয়ে দেন। যদি সেই মানুষটি সত্যিই আমাদের ভাগ্যে লেখা থাকে, তবে আল্লাহ আমাদের পুনরায় একত্রিত করবেন, আর যদি না থাকে, তবে তিনি এর চেয়ে উত্তম কাউকে আমাদের জন্য নির্ধারণ করবেন। এই ব্লগে আমরা কুরআন ও হাদিসসম্মত কিছু দোয়া, আমল এবং মানসিক দিকনির্দেশনা নিয়ে আলোচনা করব যা প্রিয় মানুষকে ফিরে পাওয়ার আশায় করা যেতে পারে।
ইসলামে ভালোবাসা ও সম্পর্কের গুরুত্ব
ইসলামে ভালোবাসা শুধু আবেগের বিষয় নয়, বরং তা ইবাদতের অংশ। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা কুরআনে বলেন:
“তাঁর নিদর্শনসমূহের মধ্যে একটি এই যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকেই স্ত্রী সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে প্রশান্তি পাও; এবং তিনি তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা ও দয়া স্থাপন করেছেন।” (সূরা রূম ৩০:২১)
এই আয়াত প্রমাণ করে যে দাম্পত্য ভালোবাসা মানুষের জীবনে সাকিনা (শান্তি) নিয়ে আসে এবং এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি বিশেষ নিয়ামত।
কুরআনের আলোকে সম্পর্কের মূল্য
কুরআন আমাদের শেখায় যে সম্পর্কগুলো শুধু দুনিয়ার জন্য নয়, বরং আখিরাতেও এর প্রভাব থাকে। স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সহযোগিতা, ক্ষমা এবং দয়া আল্লাহর সন্তুষ্টির কারণ হয়।
“তোমরা একে অপরের জন্য পোশাকস্বরূপ।” (সূরা বাকারা ২:১৮৭)
এই আয়াত ইঙ্গিত করে যে সম্পর্কের মধ্যে আচ্ছাদন, নিরাপত্তা ও সম্মান থাকা উচিত।
নবী ﷺ-এর হাদিসে ভালোবাসা ও বিবাহ
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:
“তোমাদের মধ্যে সে-ই উত্তম, যে তার পরিবারের জন্য উত্তম।” (সুনান তিরমিজি ৩৮৯৫)
এটি দেখায় যে পরিবারের প্রতি ভালোবাসা, যত্ন, এবং সুন্দর ব্যবহার ঈমানের নিদর্শন। নবী ﷺ স্ত্রীদের সাথে ভালো ব্যবহার করতেন এবং এটি উম্মতের জন্য আদর্শ বানিয়েছেন।
ভালোবাসার মানুষকে ফিরে পাওয়ার জন্য দোয়া
কুরআনের দোয়া
তুমি চাইলে এই দোয়াটি করতে পারো, যা কল্যাণকর সম্পর্কের জন্য উপযোগী:
رَبَّنَا هَبْ لَنَا مِنْ أَزْوَاجِنَا وَذُرِّيَّاتِنَا قُرَّةَ أَعْيُنٍ وَاجْعَلْنَا لِلْمُتَّقِينَ إِمَامًا
বাংলা উচ্চারণ: রাব্বানা হাব লানা মিন আজওয়াজিনা ওয়া যুররিয়্যাতিনা কুররাতা আ’ইউনিন ওয়াজআলনা লিলমুত্তাকিনা ইমামা।
অর্থ: “হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদের স্ত্রী ও সন্তানদের আমাদের চোখের শীতলতা দান কর এবং আমাদের মুত্তাকীদের জন্য আদর্শ বানিয়ে দাও।” (সূরা ফুরকান ২৫:৭৪)

আরো পড়ুন:
হাদিসের দোয়া
রাসূল ﷺ আমাদের শিখিয়েছেন—
اللَّهُمَّ أَلِّفْ بَيْنَ قُلُوبِنَا، وَأَصْلِحْ ذَاتَ بَيْنِنَا، وَاهْدِنَا سُبُلَ السَّلَامِ
বাংলা উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা আল্লিফ বাইনাকুলুবিনা, ওয়া আসলিহ যায়াতা বাইনিনা, ওয়া-হদিনা সুবুলাসসালাম।
অর্থ: “হে আল্লাহ, আমাদের অন্তরগুলোকে একত্রিত করুন, আমাদের পারস্পরিক সম্পর্ক ঠিক করে দিন এবং আমাদেরকে শান্তির পথে পরিচালিত করুন।” (সুনান আন-নাসাই ১২৮৯)
ব্যক্তিগত মুনাজাতের উদাহরণ
ব্যক্তিগতভাবে এভাবে দোয়া করতে পারো:
“হে আল্লাহ, আপনি আমার হৃদয়ের অবস্থা জানেন। যদি অমুক (নাম উল্লেখ করো) আমার জন্য কল্যাণকর হয়, তবে তার হৃদয়ে আমার জন্য ভালোবাসা সৃষ্টি করুন এবং আমাদের পুনরায় একত্রিত করুন। আর যদি সে আমার জন্য কল্যাণকর না হয়, তবে আমাকে তার ভালোবাসা থেকে মুক্ত করুন এবং এর চেয়ে উত্তম কাউকে আমার জন্য নির্ধারণ করুন।”
কিভাবে দোয়া করতে হবে?
দোয়া হলো বান্দা ও আল্লাহর সরাসরি যোগাযোগ। তাই এটি করতে হবে আন্তরিক হৃদয়ে, সম্পূর্ণ ভরসা রেখে। কেবল মুখের কথা নয়, হৃদয়ের গভীর অনুভূতি দিয়ে আল্লাহর কাছে চাওয়া চাই। দোয়ার আগে নিজের পাপের জন্য তওবা করা, আল্লাহর প্রশংসা করা, রাসূল ﷺ-এর উপর দরুদ পাঠ করা এবং তারপর দোয়া শুরু করা উচিত।
দোয়া করার সময় ও শিষ্টাচার
দোয়া কবুল হওয়ার জন্য কিছু বিশেষ সময় ও শিষ্টাচার রয়েছে—
১. বিশেষ সময়:
- নামাজের পর: প্রতিটি ফরজ নামাজের পর দোয়া করা।
- আযানের পর ও ইকামতের আগে: রাসূল ﷺ বলেছেন, এ সময় দোয়া ফিরিয়ে দেওয়া হয় না।
- ইফতারের আগে: রোজাদারের দোয়া কবুল হয়।
- শুক্রবার আসরের পর থেকে মাগরিবের আগে: দোয়া কবুলের একটি বিশেষ সময়।
- রাতের শেষ অংশে: তাহাজ্জুদের সময় দোয়া।
২. শিষ্টাচার:
- হাত তুলে দোয়া করা।
- আল্লাহর প্রশংসা দিয়ে শুরু করা।
- দরুদ পাঠ করে দোয়া করা।
- আন্তরিকভাবে কাঁদা বা হৃদয়ের ব্যথা প্রকাশ করা।
- একবার নয়, বারবার দোয়া করা।
রাতের শেষ অংশে দোয়া
রাতের শেষ অংশে (তাহাজ্জুদের সময়) দোয়া করা সবচেয়ে উত্তম।
রাসূল ﷺ বলেছেন:
“প্রতিদিন রাতে শেষ তৃতীয়াংশে আল্লাহ আসমানের সবচেয়ে কাছের আসমানে নেমে আসেন এবং বলেন: কে আমাকে ডাকছে? আমি তার ডাকে সাড়া দেব। কে আমার কাছে চাইছে? আমি তাকে দেব। কে আমার কাছে ক্ষমা চাইছে? আমি তাকে ক্ষমা করব।” (সহিহ বুখারি ১১৪৫)
এই সময় শান্ত পরিবেশে দুই রাকাত বা চার রাকাত তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ে আন্তরিকভাবে প্রিয় মানুষের জন্য দোয়া করা যেতে পারে।
সালাতুল হাজাত পড়া
সালাতুল হাজাত এমন একটি নামাজ যা জরুরি প্রয়োজনের জন্য পড়া হয়।
পদ্ধতি:
- দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ো।
- প্রথম রাকাতে সূরা ফাতিহা শেষে সূরা কুলহুয়াল্লাহু আহাদ পড়ো।
- দ্বিতীয় রাকাতে সূরা ফাতিহা শেষে সূরা ইনশিরাহ (আলম নাশরাহ) পড়ো।
- নামাজ শেষে আল্লাহর প্রশংসা করো, দরুদ শরীফ পড়ো এবং তারপর আন্তরিকভাবে তোমার প্রয়োজনের কথা বলো।
এই নামাজ পড়ার মাধ্যমে বান্দা তার প্রয়োজন সরাসরি আল্লাহর দরবারে পেশ করে।
নিজের আমল ও চরিত্র ঠিক করা
প্রিয় মানুষকে ফিরে পাওয়ার জন্য দোয়া করার আগে নিজের আমল ও চরিত্র ঠিক করা অত্যন্ত জরুরি। যদি সম্পর্ক ভাঙার পেছনে নিজের ভুল থাকে, তাহলে প্রথমে তওবা করতে হবে। মিথ্যা, প্রতারণা, রাগ, গীবত ইত্যাদি থেকে বিরত থাকা উচিত। চরিত্র সুন্দর করা এবং আল্লাহর সাথে সম্পর্ক মজবুত করা—এটাই হলো দোয়া কবুল হওয়ার অন্যতম শর্ত।
মনস্তাত্ত্বিক ও আধ্যাত্মিক দিকনির্দেশনা
ধৈর্য ধারণ
ধৈর্য হলো ঈমানের একটি বড় অংশ। কষ্টের সময়ে ধৈর্য ধারণ করলে আল্লাহ তার বিনিময়ে কল্যাণ দান করেন।
“নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথেই আছেন।” (সূরা বাকারা ২:১৫৩)
ইতিবাচক চিন্তা রাখা
হতাশা আল্লাহর রহমতের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। নিজেকে মনে করিয়ে দাও যে আল্লাহর কাছে কিছুই অসম্ভব নয়। ইতিবাচক চিন্তা রাখলে মন শান্ত থাকে এবং দোয়া করাও সহজ হয়।
আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল
তাওয়াক্কুল মানে হলো সব চেষ্টা করার পর ফলাফলের ব্যাপারটা আল্লাহর উপর ছেড়ে দেওয়া। যদি প্রিয় মানুষটি তোমার ভাগ্যে থাকে, আল্লাহ তাকে ফিরিয়ে দেবেন। আর যদি না থাকে, তবে তিনি এর চেয়ে উত্তম কাউকে তোমার জন্য নির্ধারণ করবেন।
ফিকহি পরামর্শ
আলেমদের মতামত
ইসলামী আলেমরা বলেছেন—যে দোয়া কল্যাণ বয়ে আনে, সেটি করা জায়েজ। যেমন স্বামী-স্ত্রীর মিলন, পরিবারে শান্তি, ভালোবাসা ও বোঝাপড়া বৃদ্ধি। তবে অন্যায় বা হারাম সম্পর্কের জন্য দোয়া করা বৈধ নয়।
কোন দোয়া বৈধ আর কোনটা নয়
✅ বৈধ দোয়া:
- বৈধ সম্পর্কের পুনর্মিলনের জন্য দোয়া
- সম্পর্কের ভুল বোঝাবুঝি দূর করার দোয়া
- পরস্পরের ভালোবাসা বৃদ্ধি করার দোয়া
❌ অবৈধ দোয়া:
- হারাম সম্পর্ক স্থায়ী করার জন্য দোয়া
- কারো স্বামী বা স্ত্রীকে কেড়ে নেওয়ার জন্য দোয়া
- কালো যাদু বা তাবিজের মাধ্যমে জোর করে কারো মন পরিবর্তনের চেষ্টা
উপসংহার
আশা ও তাওয়াক্কুলের বার্তা
প্রিয় মানুষকে ফিরে পাওয়ার দোয়া করার পরও মনে রাখতে হবে—ফলাফল আল্লাহর হাতে। তাঁর সিদ্ধান্ত সর্বোত্তম। তিনি যদি তোমাদের পুনরায় একত্রিত করেন, তবে সেটি হবে কল্যাণের জন্য। আর যদি না করেন, তবে বুঝতে হবে এর পেছনে হিকমত রয়েছে।
পাঠকের জন্য অনুপ্রেরণামূলক কিছু কথা
প্রিয় পাঠক, মনে রেখো—আল্লাহর দরজা সবসময় খোলা। দোয়া করো, নিজের চরিত্র ঠিক করো, এবং আল্লাহর উপর সম্পূর্ণ ভরসা রাখো। হতাশ হয়ো না, কারণ রাসূল ﷺ বলেছেন:
“যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে, আল্লাহ তার জন্য যথেষ্ট হবেন।” (সূরা তালাক ৬৫:৩)
তুমি চেষ্টা করো, বাকিটা আল্লাহর হাতে ছেড়ে দাও। যেটি তোমার জন্য শ্রেষ্ঠ, সেটিই আল্লাহ তোমার জীবনে লিখে দেবেন।
সতর্কতা ও করণীয়
হারাম সম্পর্কের জন্য দোয়া না করা
ইসলাম সম্পর্কের পবিত্রতা রক্ষা করে। যদি সম্পর্ক হারাম হয়—যেমন অবৈধ প্রেম, অবৈধ সম্পর্ক, বা এমন কোনো ব্যক্তি যাকে বিয়ে করা ইসলামসম্মত নয়—তাহলে সেই সম্পর্ককে স্থায়ী করার জন্য দোয়া করা যাবে না। আল্লাহ কখনো হারামের মধ্যে বরকত দেন না। বরং হারাম সম্পর্ক থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য, তওবা করার জন্য, এবং নিজের ঈমান দৃঢ় করার জন্য দোয়া করা উচিত।
তাকদীরের উপর আস্থা রাখা
দোয়া করার পরও সবসময় মনে রাখতে হবে—যা আমাদের জন্য কল্যাণকর, আল্লাহ সেটিই নির্ধারণ করবেন। কুরআনে আল্লাহ বলেন:
“সম্ভবত তোমরা কোনো জিনিসকে অপছন্দ করছো, অথচ তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। আর তোমরা কোনো জিনিসকে পছন্দ করছো, অথচ তা তোমাদের জন্য ক্ষতিকর। আল্লাহ জানেন, আর তোমরা জানো না।” (সূরা বাকারা ২:২১৬)
তাকদীরের উপর আস্থা রাখা মানে দোয়া করার পর মন থেকে এই বিশ্বাস রাখা যে, আল্লাহ যা করবেন সেটাই সেরা। এতে দোয়া কবুল না হলেও মন ভেঙে যায় না, বরং তা আল্লাহর হিকমতের প্রতি সন্তুষ্টি এনে দেয়।