ভালোবাসা আসলে শুধু দুটি হৃদয়ের মিলন নয়, বরং দুই আত্মার গভীরতম সংযোগ। জীবনের ভিড়ে কখনো হঠাৎ এক মুহূর্তেই শুরু হয় সেই গল্প, যা হৃদয়ের ক্যানভাসে আজীবন আঁকা থাকে। কখনো তা হয় বৃষ্টিভেজা বিকেলের মতো নরম আর শান্ত, কখনো আবার সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো উত্তাল ও আবেগময়।
রোমান্টিক গল্পগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয়—ভালোবাসা কেবল একটি অনুভূতি নয়, বরং জীবনের সবচেয়ে সুন্দর অভিজ্ঞতা, যা মানুষকে বদলে দেয় ভেতর থেকে।
রোমান্টিক গল্প ১ : শেষ চিঠি
শীতের এক বিকেল। শহরের আকাশটায় হালকা কুয়াশা, রাস্তায় হলুদ বাতিগুলো যেন আগেভাগেই জ্বলে উঠেছে। ঠিক এমন এক বিকেলেই আরিহা ডাকবাক্সের ভেতর একটা পুরনো খাম পেল। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, চিঠিটা লেখা হয়েছিল ঠিক তার নামেই— “আরিহা”।
খামটা ছিঁড়ে খুলতেই বুকের ভেতর কেঁপে উঠল। পরিচিত হাতের লেখা— আদিয়ান।
“প্রিয় আরিহা,
হয়তো এই চিঠি তোমার হাতে পৌঁছাতে অনেক দেরি হবে। হয়তো তখন তুমি আমাকে ভুলে যাবে, কিংবা অন্য কারো হাত ধরে হাঁটবে। তবুও আমি লিখছি, কারণ কিছু অনুভূতি মুখে বলা যায় না, কিন্তু কাগজে লেখা যায়।
তুমি জানো কি, প্রথমবার তোমাকে আমি যে দেখেছিলাম, সেদিন আকাশটা ঠিক এরকম মেঘলা ছিল। তুমি লাল শাল গায়ে জড়িয়ে দাঁড়িয়েছিলে বুকশপের সামনে। বইয়ের পাতায় চোখ ডুবিয়েছিলে, অথচ আমি ডুবে গিয়েছিলাম তোমার চোখে। সেই মুহূর্তেই মনে হয়েছিল— এই মেয়েটিই আমার পৃথিবী বদলে দেবে।”
চিঠিটা পড়তে পড়তে আরিহার চোখ ভিজে গেল। সত্যিই তো, সেই দিনটার কথা সে ভুলেই গিয়েছিল। আদিয়ান অদ্ভুত ছিল— নীরব, কিন্তু গভীর। বন্ধুত্বের ভেতর লুকিয়ে থাকা এক ধরনের উষ্ণতা, যেটা হয়তো প্রেমের থেকেও শক্তিশালী।
চিঠি এগোতে লাগল—
**“তুমি হয়তো জানো না, আমাদের প্রতিটি মুহূর্ত আমি মনে রেখেছি। কলেজ শেষে বাসায় ফেরার পথে তোমার হাসি, বৃষ্টির দিনে রিকশায় বসে তোমার ভেজা চুলের গন্ধ, পরীক্ষার আগের রাতে তোমার অস্থিরতা— সবই যেন আমার জীবনের রঙ হয়ে গেছে।
আমি কখনো তোমাকে বলিনি, কিন্তু তোমার হাত ধরার জন্য কত রাত প্রার্থনা করেছি আল্লাহর কাছে। হয়তো আমি দুর্বল ছিলাম, সাহস পাইনি। শুধু ভেবেছি, একদিন যদি তোমার হাত ধরতে পারি, তাহলে পৃথিবীর সব যুদ্ধ থেমে যাবে।”**
আরিহার বুকের ভেতর কেমন অদ্ভুত ব্যথা জমতে লাগল। এতদিনে বুঝতে পারল, আদিয়ান কখনোই তার থেকে দূরে ছিল না, বরং নিজের ভেতরে তাকে ধরে রেখেছিল নিঃশব্দে।
“আরিহা,
হয়তো আমি তোমার জীবনের গল্পে একটা ক্ষুদ্র চরিত্র। হয়তো তুমি আমাকে কেবল বন্ধু হিসেবেই মনে রেখেছ। কিন্তু আমি তোমাকে সবকিছু ভেবেছি— আমার সকাল, আমার দুঃখ, আমার স্বপ্ন, এমনকি আমার শেষ নিঃশ্বাসও।
যদি কোনোদিন তুমি আমার চিঠি পড়ো, তাহলে শুধু জানবে— আমি তোমাকে ভালোবেসেছিলাম নিঃশর্তভাবে।
আর যদি কখনো আকাশের দিকে তাকাও, বুঝবে, সেই তারা গুলোই হয়তো আমার চোখ, যেখানে তোমার নাম লেখা আছে।”**
চিঠি শেষ হলো এক লাইন দিয়ে—
“আমি তোমাকে হারাতে পারি, কিন্তু ভুলতে পারব না।”
চিঠি পড়া শেষ করে আরিহা বুঝতে পারল, আদিয়ান আর নেই। বন্ধুর কাছ থেকে সে জেনেছিল কয়েক মাস আগেই আদিয়ান হঠাৎ অসুস্থ হয়ে চলে গেছে। কিন্তু এভাবে চিঠির মাধ্যমে তার প্রেম জানা— সেটা এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা।
বাইরে তখন কুয়াশার ভেতর বাতিগুলো আরও ঝাপসা হয়ে উঠছে। বুকের ভেতর হাহাকার নিয়ে আরিহা আকাশের দিকে তাকাল। মনে হলো, সত্যিই হয়তো তারা গুলো তার দিকে তাকিয়ে আছে— আদিয়ানের চোখ হয়ে।
আরিহা মৃদু স্বরে বলল,
“তুমি যদি থাকতেই, আমি হয়তো বলতাম— আমিও তোমাকে ভালোবাসি।
তার চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। আকাশের নীরবতায় সেই অশ্রু মিলেমিশে গেল, যেন এক অসমাপ্ত প্রেমের সাক্ষী হয়ে।
শেষ পর্যন্ত প্রেমটা বলা হয়নি। কিন্তু অনুভূতি কখনো মরে না— সেটা হয়তো কেবল আকাশের তারার মতো দূরে গিয়ে চিরকাল জ্বলতে থাকে।

রোমান্টিক গল্প ২ : তোমার চোখে রঙিন পৃথিবী
গ্রীষ্মের দুপুর। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের পুরনো আমগাছটার নিচে বসে রাহাত বই পড়ছিল। চারপাশে গরমের ক্লান্তি, কিন্তু তার মনটা অদ্ভুত শান্ত। হঠাৎ করেই পাশ দিয়ে এক মেয়ে হেঁটে গেল। সাদা ওড়না, হালকা নীল শাড়ি, আর কপালে ছোট্ট লাল টিপ। মুহূর্তেই রাহাতের চোখ আটকে গেল।
মেয়েটির নাম ছিল নীলিমা। বন্ধুর মুখে সে নাম শুনেছিল, কিন্তু কখনো সামনাসামনি দেখা হয়নি। আজকের এই আকস্মিক দেখা যেন তার ভেতর ঝড় তোলে দিল।
প্রথম কয়েকদিন রাহাত শুধু দূর থেকে তাকিয়ে থাকত। নীলিমার হাসি ছিল তার কাছে সুরের মতো। ক্লাস শেষে লাইব্রেরির সিঁড়িতে বসে যখন মেয়েটি বন্ধুদের সাথে গল্প করত, রাহাত মনে করত, সময় থমকে গেছে।
একদিন সাহস করে কথা বলেই ফেলল।
“মিস নীলিমা, তোমার নোটসগুলো কি একটু নিতে পারি?”
নীলিমা হেসে বলল,
“শুধু নোটস? নাকি আরেকটু বেশি কিছু চাইছ?”
রাহাত লজ্জায় মাথা নিচু করল। কিন্তু সেই প্রথম আলাপেই তাদের মধ্যে এক অদ্ভুত বোঝাপড়া জন্ম নিল।
দিনগুলো কেটে যেতে লাগল। বৃষ্টিভেজা পথে একসাথে হাঁটা, পরীক্ষার আগে একে অপরকে সাহস দেওয়া, আর ক্লাস ফাঁকি দিয়ে লেকের ধারে বসে স্বপ্ন ভাগাভাগি করা— সবকিছুতে এক অদৃশ্য বন্ধন তৈরি হচ্ছিল।
এক সন্ধ্যায়, আকাশ ভরা লাল আভা দেখে নীলিমা মৃদু স্বরে বলল,
“তুমি কি জানো, সূর্যাস্ত আমার সবচেয়ে প্রিয়? কারণ সূর্যাস্ত আমাকে মনে করিয়ে দেয়— কিছু সুন্দর জিনিস শেষ হলেও, তার স্মৃতি আকাশে রঙ হয়ে থেকে যায়।”
রাহাত চুপ করে শুনল। তারপর ধীরে ধীরে বলল,
“যদি কখনো তুমি চলে যাও, আমিও তোমাকে সূর্যাস্তের মতো মনে রাখব। রঙিন, কিন্তু অমর।”
নীলিমা চোখ নামিয়ে হাসল। সেই হাসির ভেতর লুকিয়ে ছিল এমন কিছু, যেটা রাহাত এখনো বুঝতে পারেনি।
তাদের গল্প হয়তো এভাবেই চলতে পারত। কিন্তু হঠাৎ করেই নীলিমা একদিন জানাল, তাকে বিদেশে চলে যেতে হবে পড়াশোনার জন্য।
সেদিন শেষবারের মতো তারা ক্যাম্পাসের আমগাছটার নিচে বসেছিল। চারপাশে বাতাসে ভেসে আসছিল কচি পাতার গন্ধ।
নীলিমা বলল,
“রাহাত, হয়তো আমরা আর এভাবে দেখা পাব না। কিন্তু আমি চাই, তুমি সবসময় লিখে রেখো তোমার অনুভূতিগুলো। আমি দূরে থাকলেও, সেই লেখা পড়েই হয়তো তোমাকে অনুভব করব।”
রাহাত কেঁপে উঠল। অনেক কিছু বলতে চেয়েও থেমে গেল। শুধু বলল,
“তুমি থাকো বা না থাকো, আমার পৃথিবী সবসময় তোমার চোখ দিয়েই রঙিন থাকবে।”
এরপর নীলিমা সত্যিই চলে গেল। রাহাত প্রতিদিন ডায়েরি লিখতে শুরু করল— প্রতিটি শব্দে শুধু নীলিমা।
বছর কয়েক পর, একদিন ডাকপিয়নের হাত থেকে সে একটা খাম পেল। ভেতরে মাত্র এক লাইন—

“তোমার লেখা এখনো পড়ি, আর প্রতিটি অক্ষরে তোমার প্রেম খুঁজে পাই।”
চোখ ভিজে গেল রাহাতের। সে জানল, দূরত্ব কখনো ভালোবাসাকে হারায় না। বরং অনুভূতির গভীরতাই তাকে জীবিত রাখে।
শেষ পর্যন্ত, প্রেম মানে শুধু একসাথে থাকা নয়। প্রেম মানে হলো— হাজার মাইল দূরে থেকেও একই হৃদস্পন্দন শোনা।
রোমান্টিক গল্প ৩ : অভিমান যখন প্রেমে রঙ তোলে
শরতের সোনালি বিকেল। হালকা বাতাসে কাশফুল দুলছে, আকাশটাও যেন নীল রঙে রাঙানো। সেই দৃশ্যের ভেতর দিয়েই হাঁটছিল আয়ান আর মেহরিন। দুজনের মুখে কোনো কথা নেই। অথচ নীরবতার ভেতরেই জমে আছে হাজারো অনুভূতি।
কয়েকদিন ধরে মেহরিন অভিমান করে আছে। ছোট্ট এক ভুল বোঝাবুঝি, কিন্তু তারই জন্য মুখ ভার করে বসে আছে সে। আয়ান বারবার চেষ্টা করেও কথোপকথন শুরু করতে পারছে না।
হঠাৎ মেহরিন থেমে গিয়ে বলল,
“তুমি আমাকে গুরুত্বই দাও না। তোমার দুনিয়ায় বই, বন্ধুবান্ধব আর কাজ— আমি কোথায়?”
আয়ান গভীরভাবে তার দিকে তাকাল।
“তুমি যদি জানতে, প্রতিটি কাজের ভেতর আমি তোমাকে খুঁজি, প্রতিটি বন্ধুর আড্ডায় তোমার নামই আসে আমার মনে। আমি শুধু বলতে পারি না, কারণ ভয় হয়— যদি হারিয়ে ফেলি তোমাকে।”
মেহরিন কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। বাতাসে তার চুলগুলো এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। আয়ান হাত বাড়িয়ে চুল সরিয়ে দিল।
“তুমি জানো না মেহরিন, তোমার অভিমানই আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয়। কারণ অভিমান মানেই তুমি আমাকে চাও, আমাকে নিয়ে ভাবো।”
মেহরিন চোখে জল নিয়ে বলল,
“তাহলে তুমি কেন এতদিন কিছু বললে না?”
আয়ান হাসল, মৃদু স্বরে বলল—
“কারণ আমি চাই, একদিন তুমি নিজেই বুঝবে— আমি তোমার চোখে ভেসে থাকা অশ্রুতেও তোমাকে ভালোবাসি।”
সূর্য তখন ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছে। লাল আভায় চারপাশ ভরে উঠছে। মেহরিন ধীরে আয়ানের হাতটা ধরে বলল,
“তুমি কি জানো, আমি প্রতিদিন রাতে তোমার নাম নিয়েই ঘুমাই? অভিমান করি, রাগ করি, তবুও আমার পৃথিবী শুধু তুমি।”
আয়ান আর কোনো উত্তর দিল না। শুধু তার হাত শক্ত করে চেপে ধরল।
সেদিনের সেই অভিমানই হয়ে উঠল তাদের সম্পর্কের সবচেয়ে সুন্দর স্মৃতি। তারা বুঝতে পারল— প্রেম মানে শুধু হাসি-খুশি নয়; প্রেম মানে মাঝে মাঝে অভিমান, অশ্রু, আর সেই অভিমান ভাঙানোর মিষ্টি চেষ্টা।
শেষ পর্যন্ত প্রেমটাকে পূর্ণ করে তোলে অভিমানের পরের হাসি।
রোমান্টিক গল্প ৪ : অসমাপ্ত স্বপ্ন
বর্ষার রাত। টুপটাপ বৃষ্টির শব্দে শহরটা যেন গুমোট হয়ে আছে। জানালার পাশে বসে নওরিন তাকিয়ে ছিল অন্ধকার আকাশের দিকে। হঠাৎ তার ফোনে একটা নোটিফিকেশন ভেসে উঠল— “মেহেদী: অনলাইন”।
কত বছর হলো কথা হয়নি তাদের? কলেজ জীবন থেকে শুরু হয়েছিল সম্পর্কটা। একই বেঞ্চে বসে নোট ভাগাভাগি, পরীক্ষার পর আড্ডা, লাইব্রেরিতে লুকিয়ে চিঠি লেখা— সবকিছুই ছিল এক রঙিন স্বপ্নের মতো।
কিন্তু ভাগ্য একদিন হঠাৎ সবকিছু ভেঙে দিল। মেহেদীর পরিবার তাকে বিদেশ পাঠিয়ে দিল পড়াশোনার জন্য। আর নওরিনকে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হলো তাদের দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়র সাথে। তখন তাদের বয়স ছিল খুবই কম।
আজ এত বছর পর হঠাৎ করে অনলাইনে মেহেদীর নাম দেখে বুকের ভেতর পুরনো সব স্মৃতি জেগে উঠল। সে কি মেসেজ দেবে? দ্বিধা দ্বন্দ্বের মধ্যে কেটে গেল কয়েক মিনিট। অবশেষে ছোট্ট করে লিখল—
“কেমন আছো?”
মুহূর্তেই রিপ্লাই এলো—
“ভালো আছি। তুমি?”
নওরিনের চোখ ভিজে উঠল। মনে হলো, এতদিন পরেও মেহেদীর সেই পরিচিত শব্দগুলো তার হৃদয়কে নাড়া দিয়ে গেল।
চ্যাটে কথা বাড়তে লাগল। পুরনো স্মৃতি, কলেজ জীবনের গল্প, বৃষ্টির দিনে ক্যান্টিনের চা— সবকিছু যেন আবার নতুন হয়ে উঠল।
মেহেদী লিখল,
“তুমি জানো নওরিন, আমি এখনও তোমার জন্য একটা খালি জায়গা রেখে দিয়েছি জীবনে। যদিও জানি, সেটা আর কখনো পূর্ণ হবে না।”
নওরিন দীর্ঘশ্বাস ফেলল। জানালার কাঁচে বৃষ্টির ফোঁটা গড়িয়ে পড়ছিল, ঠিক তার চোখের অশ্রুর মতো।
সে লিখল,
“আমারও তাই মনে হয়। হয়তো আমাদের গল্পটা শেষ হয়নি, শুধু থেমে গেছে।”
রাত অনেকটা গড়িয়ে গেল। দুজনেই চুপ করে গেল, শুধু স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছিল শেষ কয়েকটা শব্দ।

“আমরা কি আবার দেখা করতে পারি?” — মেহেদীর শেষ মেসেজ।
নওরিন অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে রইল সেই লাইনটার দিকে। তার ভেতরে ঝড় বইছে। কিন্তু বাস্তবতা তাকে থামিয়ে দিল।
সে ধীরে ধীরে টাইপ করল—
“না, মেহেদী। কিছু স্বপ্ন অসমাপ্তই থেকে যাক। হয়তো সেখানেই তার সৌন্দর্য।”
ফোনটা অফ করে দিল নওরিন। বাইরে বৃষ্টির শব্দ আরও জোরে পড়ছিল। আর ভেতরে তার বুকের ভেতর বেজে চলল সেই পুরনো প্রেমের ধ্বনি— অসমাপ্ত, কিন্তু চিরন্তন।
কিছু প্রেম থাকে না, তবুও কখনো মরে না। তারা শুধু রূপ নেয় অসমাপ্ত স্বপ্নে।
রোমান্টিক গল্প ৫ : অবশেষে তুমি
শীতের সকালের কুয়াশা। বিশ্ববিদ্যালয়ের কনভোকেশন মাঠে লাল টুপি আর কালো গাউন পরে সবাই আনন্দে মেতে আছে। হাসি-আড্ডার ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে আরিয়ান। চারপাশে যতই হৈচৈ হোক, তার চোখ খুঁজছে একটাই মুখ— সামিহা।
চার বছর আগে প্রথম দেখা হয়েছিল লাইব্রেরিতে। সামিহা তখন একটা রেফারেন্স বই খুঁজছিল, আরিয়ান আগে থেকে সেটা হাতে নিয়েছিল। ছোট্ট সেই ঝগড়া দিয়েই শুরু হয়েছিল তাদের গল্প। ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব, তারপর অদ্ভুত এক টান।
ক্লাস ফাঁকি দিয়ে একসাথে টিফিন খাওয়া, পরীক্ষার আগে রাত জেগে পড়া, বৃষ্টির দিনে রিকশায় ভিজে যাওয়া— সবকিছু মিলিয়ে তারা যেন একে অপরের জীবন হয়ে উঠেছিল।
কিন্তু প্রেম প্রকাশের সাহসটা আরিয়ান কখনোই পায়নি। হয়তো ভয় ছিল— যদি হারিয়ে ফেলে তাকে।
আজকের দিনটা বিশেষ। ডিগ্রির শেষ দিন, সবাই হয়তো নিজ নিজ পথে ছড়িয়ে যাবে। আরিয়ান ভাবল— আজ না বললে আর কখনো বলা হবে না।
মাঠের এক কোণে সামিহাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে এগিয়ে গেল। সামিহার হাতে ক্যামেরা, মুখে সেই চিরচেনা হাসি।
“সামিহা…”— আরিয়ান ডাকতেই মেয়েটা তাকাল।
“কি ব্যাপার? এত সিরিয়াস?”
আরিয়ান গভীরভাবে তার দিকে তাকাল। চার বছরের সব অনুভূতি এক নিঃশ্বাসে বলতে চাইলো।
“আমি… আমি তোমাকে ছাড়া আমার ভবিষ্যৎ কল্পনা করতে পারি না।”
সামিহা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর মৃদু হেসে বলল,
“চার বছর অপেক্ষা করলে, আরেকটা মুহূর্তও কি অপেক্ষা করতে পারবে না? আমি তো ভেবেছিলাম, তুমি কখনোই বলবে না।”
আরিয়ান অবাক হয়ে গেল।
“মানে… তুমি জানতেই?”
সামিহা হেসে মাথা নেড়ে বলল,
“মেয়েরা খুব সহজেই বুঝতে পারে। আমি শুধু তোমার মুখ থেকে শুনতে চাইছিলাম।”
ঠিক তখনই মাঠে আতশবাজি ফুটল, চারপাশ আলোয় ভরে গেল। সেই আলোতে আরিয়ান সামিহার হাত শক্ত করে ধরল।
“তাহলে আজ থেকে তুমি শুধু আমার?”
সামিহা মিষ্টি হেসে উত্তর দিল—
“আমি তো অনেক আগেই তোমার হয়ে গেছি।”
বাকি বন্ধুরা ছবি তুলছিল, হাসছিল, কেউ খেয়ালই করল না এই দুইজনের জীবনের সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্তটা।
শেষ পর্যন্ত প্রেমের গল্পগুলো অনেক ঘুরে আবার একসাথেই থামে— ঠিক যেমন আরিয়ান আর সামিহা।
রোমান্টিক গল্প ৬ : হারিয়ে গিয়ে ফিরে আসা
শীতের এক সকাল। শহরের পুরনো ট্রেনস্টেশনে কুয়াশা ভেসে বেড়াচ্ছে। হুইসেলের শব্দে হঠাৎ চারদিক কেঁপে উঠল। সেই ভিড়ের মাঝেই দাঁড়িয়ে আছে ফারিহা। হাতে একটা পুরনো ডায়েরি, চোখে অদ্ভুত শূন্যতা।
ডায়েরিটার পাতাগুলো অনেক আগেই হলুদ হয়ে গেছে। প্রতিটি পাতায় একই নাম লেখা— আফান।
প্রথম পরিচয়
দশ বছর আগে, কলেজে ভর্তি হওয়ার দিনটা। ফারিহা নতুন ক্যাম্পাসে একা একা ঘুরছিল। কারো সঙ্গ নেই, কেবল অনিশ্চয়তার ভয়। ঠিক তখনই পেছন থেকে এক ছেলে বলল,
“তুমি পথ হারিয়েছো?”
মুখ তুলে তাকাতেই চেনা এক উষ্ণতা। সেটাই ছিল আফান।
সেদিন থেকে শুরু হলো তাদের যাত্রা। লাইব্রেরিতে একসাথে পড়া, ক্যান্টিনে টিফিন ভাগাভাগি, ক্যাম্পাসের লেকের ধারে স্বপ্ন দেখা— সবকিছুই যেন গল্পের মতো চলছিল।
ধীরে ধীরে প্রেম
বন্ধুত্ব অদৃশ্যভাবে প্রেমে গলে গেল। ফারিহার চুলে বৃষ্টির ফোঁটা লেগে ঝরতে থাকলে আফানের চোখ আটকে যেত। পরীক্ষার আগের রাতে ফারিহা ভয় পেলে আফান বলত,
“তুমি পারবে। আমি আছি না তোমার পাশে?”
সেই কথাগুলো ফারিহার মনে শক্তি জোগাত।
কিন্তু তারা কেউই মুখে বলত না, “আমি তোমাকে ভালোবাসি।” মনে হতো, প্রেমটা এতটাই স্বাভাবিক যে শব্দে বাঁধার দরকার নেই।
হঠাৎ বিচ্ছেদ
চতুর্থ বর্ষের মাঝামাঝি সময়ে বিপর্যয় নেমে এলো। আফানের বাবা মারা গেলেন। পরিবারের দায়িত্ব একাই নিতে হলো তাকে। চাকরির সন্ধানে তাকে হঠাৎ করেই শহর ছাড়তে হলো।
বিদায়ের দিন স্টেশনে দাঁড়িয়ে আফান শুধু বলেছিল,
“আমাকে দোয়া করবে। আমি ফিরব।”
ফারিহা কেঁদে ফেলেছিল, কিন্তু কিছুই বলতে পারেনি।
এরপর থেকে যোগাযোগ আস্তে আস্তে কমে গেল। চিঠি, ফোন, মেসেজ— সবকিছুই একসময় থেমে গেল।
দীর্ঘ অপেক্ষা
সময় বয়ে গেল। ফারিহা পড়াশোনা শেষ করল, চাকরি পেল, সংসার করার চাপও এলো পরিবারের পক্ষ থেকে। কিন্তু তার ভেতরটা শূন্য হয়ে রইল। প্রতিটি উৎসবে, প্রতিটি সূর্যাস্তে, প্রতিটি শীতে তার মনে হতো— আফান কি ফিরবে না?
সে প্রতিদিন রাতে ডায়েরিতে লিখত। তার অভিমান, তার ভালোবাসা, তার স্মৃতিগুলো। প্রতিটি পাতায় একই নাম— আফান।
পুনর্মিলন
আজ সেই ডায়েরি নিয়েই ফারিহা দাঁড়িয়ে আছে স্টেশনে। কোনো কারণ ছাড়াই যেন সে টান অনুভব করছিল এখানে আসার।
হুইসেলের শব্দে যখন নতুন ট্রেনটা ঢুকল, যাত্রীদের ভিড়ের ভেতর থেকে হঠাৎ পরিচিত এক মুখ ফুটে উঠল। চেনা চোখ, চেনা হাসি— আফান!
ফারিহার বুক ধকধক করে উঠল। চোখে জল চলে এলো।
আফানও তাকিয়ে রইল, যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। তারপর ছুটে এলো তার দিকে।
“ফারিহা! তুমি… তুমি এখানে?”
শব্দ আটকে গেল দুজনের গলায়। এতদিনের অভিমান, অপেক্ষা, কষ্ট— সব মুছে গেল সেই এক মুহূর্তে।
অশ্রু আর প্রতিশ্রুতি
ফারিহা ডায়েরিটা বাড়িয়ে দিল আফানের হাতে।
“এগুলো তোমার জন্য লেখা হয়েছিল। প্রতিটি পাতায় শুধু তুমি।”
আফান কাঁপা কণ্ঠে বলল,
“আমি ফিরতে দেরি করেছি, কিন্তু কখনো ভুলিনি তোমাকে। প্রতিটি দিন, প্রতিটি রাত আমি তোমার নাম নিয়েই বেঁচে থেকেছি।”
চারপাশের ভিড়, কোলাহল, ট্রেনের শব্দ— সবকিছু যেন মিলিয়ে গেল। শুধু দুজন মানুষ দাঁড়িয়ে রইল একে অপরের চোখে ডুবে।

নতুন শুরু
সেদিন তারা সিদ্ধান্ত নিল, আর কোনোদিন আলাদা হবে না। জীবনের সমস্ত অন্ধকার, কষ্ট, দূরত্বকে পেরিয়ে তারা আবার একসাথে পথ চলবে।
স্টেশনের পুরনো ঘড়ি তখন নতুন সময় জানাচ্ছিল। যেন প্রকৃতি নিজেও সাক্ষী হচ্ছিল এক হারিয়ে যাওয়া প্রেমের ফিরে আসায়।
কিছু প্রেম দূরত্বে হারায়, কিন্তু সত্যিকারের প্রেম ফিরে আসে আবার— আরও শক্তিশালী হয়ে। আফান আর ফারিহার গল্পটা তারই প্রমাণ।