শান্তিতে ঘুমানোর দোয়া: দিনশেষে যখন সমস্ত কোলাহল স্তিমিত হয়ে আসে, মন ও শরীর ক্লান্তিতে ঢলে পড়ে—তখন প্রত্যেক মুমিনের হৃদয় আশ্রয় খোঁজে তার রবের কাছে। রাতের ঘুম শুধু বিশ্রাম নয়, এটি একটি ছোট মৃত্যু। আর এই নিদ্রা যাত্রার আগে আল্লাহর শরণ নেয়া—একটি নিরাপদ আশ্রয়ের মতো।
ইসলাম আমাদের শিখিয়েছে, ঘুমানোর আগে কিছু নির্দিষ্ট দোয়া পাঠ করলে আল্লাহর হিফাজতে রাত কাটে, ভয়-ভীতি দূর হয় এবং অন্তরে প্রশান্তি নেমে আসে। এ দোয়াগুলোর মধ্যে রয়েছে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর শেখানো কিছু দুর্দান্ত আমল, যা শুধু ঘুমের প্রস্তুতি নয়, বরং আত্মার প্রশান্তি ও ঈমানের নবায়ন হিসেবেও কাজ করে।
এই ব্লগপোস্টে আমরা জানবো সেই অমূল্য দোয়াগুলো, তাদের ফজিলত এবং হাদিসভিত্তিক প্রমাণ।
🌙 শান্তিতে ঘুমানোর দোয়া
প্রতিটি রাতের ঘুম যেন একটি ছোট মৃত্যু। চোখ বন্ধ করার আগে কে জানে আবার চোখ খুলে দেখা হবে কি না! তাই ইসলাম আমাদের শিখিয়েছে ঘুমানোর আগে দোয়া পড়ে আল্লাহর স্মরণে রাত কাটাতে। এই দোয়াগুলো আমাদের রক্ষা করে অশান্তি, দুঃস্বপ্ন এবং শয়তানের কুমন্ত্রণার হাত থেকে। একই সঙ্গে অন্তরে এনে দেয় প্রশান্তি ও নিরাপত্তার আশ্বাস।
🕊️ মূল দোয়া
اللَّهُمَّ بِاسْمِكَ أَمُوتُ وَأَحْيَا
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা বিস্মিকা আমূতু ওয়া আহইয়া
অর্থ: “হে আল্লাহ! আপনার নামেই আমি মরি এবং আপনার নামেই আবার জীবিত হই।”
📜 ফজিলত ও হাদীস প্রমাণ
🔹 এই দোয়াটি নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতিদিন ঘুমানোর আগে পাঠ করতেন এবং সাহাবিদেরও এ দোয়া শিখাতেন।
📖 হাদীস:
عَنْ حُذَيْفَةَ، قَالَ كَانَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم إِذَا أَوَى إِلَى فِرَاشِهِ قَالَ “ اللَّهُمَّ بِاسْمِكَ أَمُوتُ وَأَحْيَا
বাংলা অনুবাদ: হুযাইফা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন বিছানায় যেতেন, তখন বলতেন, “হে আল্লাহ! আমি আপনার নামে মরি ও জীবিত হই।”
📚 সূত্র: সহীহ বুখারী, হাদীস: ৬৩২৪
🌼 ঘুমানোর আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ দোয়া ও আমল
১. বিছানায় উঠার সময়
بِاسْمِكَ رَبِّي وَضَعْتُ جَنْبِي وَبِكَ أَرْفَعُهُ
উচ্চারণ: বিসমিকা রাব্বি ওয়াদ’আত্তু জানবী ওয়াবিকা আরফাআহু
অর্থ: “হে আমার প্রতিপালক! তোমার নামেই আমি আমার পার্শ্বদেশ বিছানায় রাখলাম এবং তোমারই সাহায্যে উঠবো।”
📚 সূত্র: সহীহ বুখারী, হাদীস: ২৪৭

২. তিনবার সুরা ইখলাস, ফালাক ও নাস পড়ে নিজেকে হাত বুলিয়ে মোছা।
ফজিলত: নবীজি (সা.) ঘুমানোর আগে নিজ হাতে এই সূরাগুলো পড়ে সমস্ত শরীর মোছেন। এটি দৃষ্টান্তমূলক আমল।
📚 সূত্র: সহীহ বুখারী, হাদীস: ৫০১৭
৩. আয়াতুল কুরসী পাঠ
ফজিলত: ব্যক্তি ঘুমানোর সময় আয়াতুল কুরসী পড়ে, সে সারারাত আল্লাহর হিফাজতে থাকে, এবং শয়তান তার কাছে আসে না।
📚 সূত্র: সহীহ বুখারী, হাদীস: ২৩১১
🌙 শান্তিতে ঘুমানোর ইসলামিক নির্দেশিকা
🛏 ১. পবিত্র অবস্থায় ঘুমানো
ওজু করে ঘুমানো
নবীজি ﷺ বলেছেন,
“যে ব্যক্তি পবিত্র অবস্থায় ঘুমায়, রাতের যে সময়েই জেগে উঠে আল্লাহর যিকির করে ও দোয়া করে, তার দোয়া কবুল করা হয়।” 📚 (সহীহ বুখারী, হাদীস: ১১৪৯)
🕌 ২. ঘুমানোর আগে ফারয নামাজ আদায়
বিশেষত এশার নামাজ। হাদীস অনুযায়ী, এশা ও ফজরের নামাজ জামাআতে আদায়কারী সারা রাত ইবাদতের সওয়াব পায়। 📚 (সহীহ মুসলিম, হাদীস: ৬৫৬)
🤲 ৩. নির্দিষ্ট দোয়া ও যিকির করা
দোয়া
اللَّهُمَّ بِاسْمِكَ أَمُوتُ وَأَحْيَا
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা বিসমিকা আমূতু ওয়া আহইয়া
অর্থ: “হে আল্লাহ! আপনার নামেই আমি মরি এবং আপনার নামেই আবার জীবিত হই।” 📚 (সহীহ বুখারী, হাদীস: ৬৩২৪)
আয়াতুল কুরসি: ঘুমানোর আগে পড়লে সারারাত হিফাজতে থাকেন। 📚 (সহীহ বুখারী, হাদীস: ২৩১১)
সুরা ইখলাস, ফালাক ও নাস – ৩ বার পড়ে শরীর মোছা 📚 (সহীহ বুখারী, হাদীস: ৫০১৭)
🛌 ৪. বিছানায় ডান কাত হয়ে ঘুমানো
হাদীসে এসেছে, নবীজি ﷺ ডান পাশে কাত হয়ে ঘুমাতেন এবং বলেন: “ডান কাত হয়ে শয়ন কর।” 📚 (সহীহ বুখারী, হাদীস: ২৪৭)
☪️ ৫. শেষ ৩ আয়াত সূরা বাকারার পাঠ
ঘুমানোর আগে পড়লে তা যথেষ্ট হয় (রক্ষার দিক দিয়ে)। 📚 (সহীহ বুখারী, হাদীস: ৫০০৯)
❌ ৬. অহেতুক কথা, গসিপ ও গান-বাজনা এড়িয়ে চলা
হাদীস অনুযায়ী, অপ্রয়োজনীয় কথা বলা ও খেলাধুলার মধ্যে রাত কাটানো মুমিনের জন্য অনুচিত।
💭 ৭. অন্তরকে পরিষ্কার রেখে ঘুমানো
কাউকে মাফ করে, হিংসা-মালিন্য ছাড়াই ঘুমানো নবীজির ﷺ অভ্যাস ছিল।
🌙 উপসংহার
একটি মুমিনের রাত শুরু হয় আল্লাহর নামে এবং শেষ হয় তাঁর ইচ্ছায়। প্রতিদিন ঘুমানোর আগে এই দোয়াগুলো পাঠ করে আমরা যেমন শারীরিক নিরাপত্তা লাভ করি, তেমনি আত্মিক প্রশান্তিও লাভ করি। ইসলাম শুধুমাত্র ইবাদতের নয়, বরং জীবনের প্রতিটি ছোটখাটো কাজেও রয়েছে সুন্দর ও সুশৃঙ্খল দিকনির্দেশনা। আসুন, আজ রাত থেকেই আল্লাহর নাম নিয়ে ঘুমানো শুরু করি, যেন প্রতিটি রাত হয়ে ওঠে শান্তির রাত।
শান্তিতে ঘুমানোর দোয়া বিষয়ে কয়েকটি প্রশ্ন ও উত্তর
১. ঘুমানোর আগে ওজু করা কি জরুরি?
✅ উত্তর: না, ফরয নয়, তবে এটি সুন্নাত এবং অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ। ওজু করে ঘুমালে ফেরেশতা সারা রাত দোয়া করতে থাকে। 📚 (সহীহ ইবনু হিব্বান: ৯৬২)
২. আয়াতুল কুরসি পড়ার ফলে কী উপকার হয়?
✅ উত্তর: যে ব্যক্তি ঘুমানোর আগে আয়াতুল কুরসি পড়ে, সে রাতভর আল্লাহর হেফাজতে থাকে এবং শয়তান তার কাছে আসে না। 📚 (সহীহ বুখারী: ২৩১১)
৩. ঘুমানোর আগে তিনটি সূরা কেন পড়া হয়?
✅ উত্তর: সূরা ইখলাস, ফালাক ও নাস নবীজি ﷺ নিজের উপর পড়ে শরীর মোছার মাধ্যমে শয়তান ও দুঃস্বপ্ন থেকে রক্ষা চাইতেন। 📚 (সহীহ বুখারী: ৫০১৭)
৪. ডান পাশে কাত হয়ে ঘুমানো কেন গুরুত্বপূর্ণ?
✅ উত্তর: নবীজি ﷺ সবসময় ডান কাত হয়ে ঘুমাতেন এবং সাহাবিদেরও এটি করতে বলতেন। এটি সুন্নাত ও স্বাস্থ্যকরও বটে। 📚 (সহীহ বুখারী: ২৪৭)
৫. কোন দোয়াটি ঘুমের সময় সর্বোত্তম?
✅ উত্তর:
اللَّهُمَّ بِاسْمِكَ أَمُوتُ وَأَحْيَا
(আল্লাহুম্মা বিসমিকা আমুতু ওয়া আহইয়া) – এটি নবীজি ﷺ ঘুমের সময় নিয়মিত বলতেন। 📚 (সহীহ বুখারী: ৬৩২৪)