শারীরিক শক্তি বৃদ্ধির দোয়া । ৫ টি ইসলমিক উপায় ও আমল

পোস্টটি শেয়ার করুন

মানুষের জীবনে শারীরিক সুস্থতা এবং শক্তি এক অমূল্য সম্পদ। দৈনন্দিন কাজকর্ম, ইবাদত-বন্দেগি, পরিবার-পরিজনের দায়িত্ব এবং জীবনের নানান চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমাদের শারীরিক শক্তির প্রয়োজন পড়ে। অনেক সময় পরিশ্রম, অসুস্থতা কিংবা মানসিক চাপের কারণে শরীর দুর্বল হয়ে যায়। ইসলাম শুধু শারীরিক চিকিৎসা বা স্বাস্থ্যবিধির কথা বলেনি, বরং শারীরিক শক্তি ও সুস্থতার জন্য আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনার শিক্ষা দিয়েছে। বিভিন্ন দোয়া ও জিকির রয়েছে, যা শারীরিক শক্তি বৃদ্ধির জন্য সহায়ক হতে পারে। এই ব্লগপোস্টে আমরা শারীরিক শক্তি বৃদ্ধির জন্য কিছু সুন্দর ও প্রমাণিত দোয়া, তাদের অর্থ ও ফজিলত তুলে ধরব, যেন আমরা শারীরিক ও আত্মিক উভয় শক্তিতে সমৃদ্ধ হতে পারি।

১. শারীরিক শক্তি বৃদ্ধির জন্য গুরুত্বপূর্ণ দোয়া

দোয়া-১

اَللّٰهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ الْعَافِيَةَ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ

উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকাল ‘আফিয়াতা ফিদ দুনিয়া ওয়াল আখিরাহ।

অর্থ: হে আল্লাহ, আমি তোমার কাছে দুনিয়া ও আখিরাতে সুস্থতা কামনা করছি।

ফজিলত: এই দোয়া শুধু শারীরিক নয়, মানসিক ও আত্মিক সুস্থতার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। নিয়মিত এই দোয়া পড়লে আল্লাহ রোগ-ব্যাধি, দুর্বলতা এবং বিপদ থেকে রক্ষা করেন।

দোয়া-২

اَللّٰهُمَّ قَوِّنِي فِي بَدَنِي وَبَارِكْ لِي فِي سَمْعِي وَبَصَرِي

উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা ক্বাও্বিনী ফি বাদানি ওয়া বারিক লি ফি সাম’ঈ ওয়া বসরি।

অর্থ: হে আল্লাহ, আমার শরীরকে শক্তিশালী কর এবং আমার শ্রবণশক্তি ও দৃষ্টিশক্তিতে বরকত দান কর।

ফজিলত: শরীর, চোখ ও কান সুস্থ রাখা ইবাদতের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই দোয়া আল্লাহর কাছে শারীরিক শক্তি ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সুরক্ষার জন্য প্রার্থনা।

দোয়া-৩

اَللّٰهُمَّ اشْفِ أَبْدَانَنَا وَقَوِّ أَجْسَادَنَا

উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা ইশফি আবদা-নানা ওয়া ক্বাও্বি আজসাদানা।

অর্থ: হে আল্লাহ, আমাদের দেহকে আরোগ্য দাও এবং আমাদের শরীরকে শক্তিশালী কর।

ফজিলত: এই দোয়া রোগমুক্তি এবং শরীরের দুর্বলতা দূর করার জন্য পড়া যেতে পারে। আল্লাহর কাছে সরাসরি শারীরিক শক্তির প্রার্থনা।

শারীরিক শক্তি বৃদ্ধির দোয়া আরবি ও বাংলা
শারীরিক শক্তি বৃদ্ধির দোয়া আরবি ও বাংলা

শারীরিক শক্তি বৃদ্ধির কিছু ইসলামিক উপদেশ

সুন্নতি খাদ্যাভ্যাস মেনে চলা:

  • পরিমাণমতো খাওয়া
  • হালাল ও পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ
  • খাওয়ার আগে ও পরে বিসমিল্লাহ এবং আলহামদুলিল্লাহ বলা

শরীরচর্চা করা: রাসুল (সা.) নিজেই শারীরিকভাবে সবল ছিলেন। হাঁটা, সাঁতার, তীরন্দাজি, কুস্তি—সবই তিনি উৎসাহিত করেছেন।

পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়া: শরীর বিশ্রাম না পেলে দুর্বল হয়ে পড়ে। ঘুমও এক ধরনের ইবাদত।

মানসিক চাপ থেকে দূরে থাকা: অতিরিক্ত মানসিক চাপ শরীর দুর্বল করে ফেলে। তাই বেশি দুঃশ্চিন্তা থেকে বিরত থাকা উচিত।

নিয়মিত দোয়া করা: দোয়া মুমিনের সবচেয়ে বড় অস্ত্র। শারীরিক শক্তির জন্য দোয়া নিয়মিত করতে হবে।

হাদিসের রেফারেন্সসহ দোয়া

দোয়া ১

আরবি:

اللهم إني أسألك العافية في الدنيا والآخرة

উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকাল ‘আফিয়াতা ফিদ্দুনিয়া ওয়াল আখিরাহ।

অর্থ: হে আল্লাহ, আমি তোমার কাছে দুনিয়া ও আখিরাতে সুস্থতা কামনা করছি।

হাদিসের উৎস: এ দোয়া এসেছে বিভিন্ন হাদিসে। বিশেষভাবে, তিরমিজি শরিফে (হাদিস নং: ٣٥١٢) আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: “আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমার জন্য কিছু দোয়া শিখিয়ে দিন। তিনি বললেন: সর্বপ্রথম আল্লাহর কাছে ‘আফিয়াহ’ চাই।” অর্থাৎ সুস্থতা ও নিরাপত্তা।

দোয়া ২

আরবি:

اللهم قوّني في بدني وبارك لي في سمعي وبصري

উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা ক্বাউ্বিনী ফি বাদানি ওয়াবারিক লি ফি সাম’ঈ ওয়াবসরি।

অর্থ: হে আল্লাহ, আমার শরীরকে শক্তিশালী কর, এবং আমার শ্রবণ ও দৃষ্টিতে বরকত দাও।

হাদিসের উৎস: এই দোয়া মুসলিম শরিফে এসেছে (সহীহ মুসলিম, হাদিস নং: ২৭১২), যেখানে রাসুল (সা.) বলেছেন, “হে আল্লাহ! আমার দেহকে শক্তি দাও, এবং আমার শ্রবণ ও দৃষ্টিতে বরকত রাখ।” যদিও আকারে কিছু ভিন্নতা দেখা যায় বিভিন্ন বর্ণনায়।

দোয়া ৩

আরবি:

اللهم اشف أبداننا وقوِّ أجسادنا

উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা ইশফি আবদা-নানা ওয়া ক্বাউ্বি আজসাদানা।

অর্থ: হে আল্লাহ, আমাদের দেহকে আরোগ্য দাও এবং আমাদের শরীরকে শক্তিশালী কর।

হাদিসের উৎস: এই দোয়া সরাসরি নির্দিষ্ট কোনো হাদিসে একসাথে নেই, তবে “اللهم اشف مرضانا” বা “হে আল্লাহ, আমাদের রোগীদের শেফা দাও”—এ দোয়া বিভিন্ন হাদিসে এসেছে। যেমন সহিহ বুখারি (হাদিস নং: ৫৭৪৩)।

আরো পড়ুন:

কুরআনের আয়াত

শারীরিক সুস্থতা, শক্তি বা আরোগ্য নিয়ে কুরআনে অনেক আয়াত আছে। কিছু গুরুত্বপূর্ণ আয়াত নিচে দেওয়া হলো:

আয়াত-১

وَإِذَا مَرِضْتُ فَهُوَ يَشْفِينِ

উচ্চারণ: ওয়া ইযা মারিদ্তু ফাহুয়া ইয়াশফীন।

অর্থ: “আর আমি অসুস্থ হলে তিনিই আমাকে আরোগ্য দেন।”
— (সুরা আশ-শু‘আরা, ২৬:৮০)

তাফসির থেকে ব্যাখ্যা: তাফসিরে ইবনে কাসিরে বলা হয়েছে, আল্লাহই একমাত্র আরোগ্যদাতা। মানুষ চেষ্টামাত্র করতে পারে, কিন্তু শিফা আসে আল্লাহর পক্ষ থেকেই।

আয়াত-২

قُلْ هُوَ لِلَّذِينَ آمَنُوا هُدًى وَشِفَاءٌ

উচ্চারণ: কুল হুয়া লিল্লাযীনা আমানু হুদা ওয়াশিফাউ।

অর্থ: বলুন, এটা (কুরআন) মু’মিনদের জন্য হিদায়াত ও শিফা। — (সুরা ফুসসিলাত, ৪১:৪৪)

তাফসির থেকে ব্যাখ্যা: তাফসিরে বলা হয়েছে, কুরআনের তিলাওয়াত অন্তরের অসুখ দূর করে এবং শারীরিক রোগের জন্যও উপকারী হতে পারে, যদি আল্লাহ চান।

প্রাকটিক্যাল টিপস

কখন পড়া ভালো?

  • সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর
  • রাতে ঘুমানোর আগে
  • অসুস্থতা অনুভব করলে
  • দৈনন্দিন যিকিরের মধ্যে রাখলে ভালো

কতবার পড়তে হবে?

  • কোনো নির্দিষ্ট সংখ্যা নেই, তবে তিনবার পড়া সাধারণত অনেক দোয়ায় সুন্নতভাবে করা হয়।
  • শারীরিক কষ্ট বেশি হলে বেশি বেশি পড়া যায়।

সকাল-সন্ধ্যার যিকিরে রাখা যায়?
অবশ্যই। রাসুল (সা.)-এর সকাল-সন্ধ্যার যিকিরের অনেকগুলোতে শারীরিক সুস্থতা প্রার্থনার দোয়া রয়েছে। এ দোয়াগুলোও সেখানে যোগ করা যেতে পারে।

বিশ্বাস ও মনোযোগ
দোয়া পড়ার সময় মনোযোগ এবং আল্লাহর ওপর বিশ্বাস খুব গুরুত্বপূর্ণ। শুধু ঠোঁটের উচ্চারণ নয়, অন্তর থেকেও চাইতে হবে।

✅ রোগভিত্তিক দোয়া

নিচে কিছু নির্দিষ্ট সমস্যা বা শারীরিক দুর্বলতার জন্য প্রমাণিত বা সুন্নত দোয়া উল্লেখ করছি:

১. শারীরিক ব্যথার জন্য দোয়া

রাসুল (সা.) বলেছেন:

“যে ব্যক্তি কোন স্থান ব্যথা অনুভব করবে, সে যেন হাত সেই স্থানে রাখে এবং তিনবার বলে— بِسْمِ اللَّهِ (বিসমিল্লাহ), এরপর সাতবার বলে—

أَعُوذُ بِعِزَّةِ اللَّهِ وَقُدْرَتِهِ مِنْ شَرِّ مَا أَجِدُ وَأُحَاذِرُ”

উচ্চারণ: আউযু বি’ইজ্জাতিল্লাহি ওয়াকুদরাতিহি মিন শাররি মা আজিদু ওয়া উহাযিরু।

অর্থ: আমি আশ্রয় চাই আল্লাহর মহিমা ও শক্তির মাধ্যমে, যা কিছু ব্যথা আমি অনুভব করছি এবং যা থেকে আমি আশঙ্কা করছি।

হাদিসের রেফারেন্স: সহিহ মুসলিম, হাদিস নং: ২২০২

২. দুর্বলতা বা ক্লান্তির জন্য দোয়া

রাসুল (সা.) ফাতিমা (রা.)-কে শিখিয়েছিলেন:

“তুমি কি এমন কিছু পছন্দ কর না যা কাজের চেয়ে ভালো? ঘুমাতে যাওয়ার আগে ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ, ৩৩ বার আলহামদুলিল্লাহ এবং ৩৪ বার আল্লাহু আকবর বল।”

ফজিলত: এই যিকির ক্লান্তি দূর করে, শরীরকে শক্তি যোগায়, এবং মানসিকভাবে প্রশান্তি দেয়।

হাদিসের রেফারেন্স:
সহিহ বুখারি, হাদিস নং: ৩৭০৫

✅ অনুপ্রেরণামূলক গল্প বা ঘটনা

ঘটনা: সাহাবী অসুস্থ হলে রাসুল (সা.)-এর দোয়া

সাহাবী সা’দ ইবনে আবী ওয়াক্কাস (রা.) অসুস্থ হলে রাসুল (সা.) তার কাছে গিয়ে বললেন:

“لا بأس طهور إن شاء الله”

(লা বা’স, তহুর ইন শা’আল্লাহ)

উচ্চারণ: লা বা’স, তহুর ইন শা’আল্লাহ।

অর্থ: কোনো সমস্যা নেই, ইনশাআল্লাহ এটা তোমার জন্য পাপমোচন ও পবিত্রতা হবে।

হাদিসের রেফারেন্স: সহিহ বুখারি, হাদিস নং: ৫৬৬২

🔹 গল্প থেকে শিক্ষা: রাসুল (সা.) অসুস্থকে শুধু শারীরিক সান্ত্বনা দেননি, বরং তাকে মানসিকভাবেও শক্ত করেছেন। এই দোয়া অসুস্থ মানুষকে আশ্বস্ত ও সাহসী করে তোলে।

উপসংহার

শারীরিক শক্তি মহান আল্লাহর দেয়া এক অমূল্য উপহার। আমাদের চেষ্টা, চিকিৎসা, খাদ্যাভ্যাস—সবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে সবশেষে ভরসা একমাত্র আল্লাহর ওপর। তাই শারীরিক দুর্বলতা বা রোগব্যাধির সময়ে, এমনকি সুস্থ থাকার সময়ও আমাদের আল্লাহর কাছে শক্তি ও সুস্থতার জন্য দোয়া করতে হবে। আল্লাহ যেন আমাদের সবাইকে শারীরিক শক্তি, সুস্থতা ও ইবাদতের জন্য সবলতা দান করেন। আমিন।


পোস্টটি শেয়ার করুন
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x