মানুষের জীবনে এমন অনেক প্রাকৃতিক বিষয় আছে, যা কখনো আনন্দের, কখনো বিব্রতকর। স্বপ্নদোষ তেমনই একটি বিষয়—যা বিশেষ করে যুবকদের জীবনে ঘটে থাকে, আবার অনেকেই এ নিয়ে দ্বিধা বা অজ্ঞতায় ভোগেন। অনেক সময় জানা না থাকায় মানুষ সন্দিহান হয়ে পড়ে— স্বপ্নদোষ হলে বিছানা-কাপড় কি নাপাক হবে? কুরআন ও হাদিস যা বলে।? বিছানার কী হবে? নামাজ আদায় কি হবে এই কাপড় পরে? ইসলাম কী বলে এ বিষয়ে?
এই ব্লগপোস্টে আমরা আলোচনা করবো—স্বপ্নদোষের কারণে শরীর, কাপড় বা বিছানা নাপাক হয় কি না, এবং ইসলামic দৃষ্টিকোণ থেকে কী করণীয়। দ্বীন বুঝে চলতে চাওয়া প্রতিটি মুমিনের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক বিষয়।
স্বপ্নদোষ হলে বিছানা ও কাপড় কি নাপাক হয়?
🔹 স্বপ্নদোষ কী?
স্বপ্নদোষ (احتلام – ইহতিলাম) হচ্ছে এমন একটি অবস্থা, যখন কোনো ব্যক্তি ঘুমন্ত অবস্থায় যৌন উত্তেজনাজনিত কারণে বীর্যপাত করে। এটি স্বাভাবিক শারীরিক প্রক্রিয়া, বিশেষত বয়ঃসন্ধির পর পুরুষ ও নারীদের জীবনে দেখা দেয়।
❖ কাপড় ও বিছানা কি নাপাক হয়?
🔸 মূল প্রশ্নের উত্তর
যদি বীর্য (মনী/منی) কাপড় বা বিছানায় লেগে যায়, তবে তা নাপাক (نجس) হবে। সে কাপড় বা বিছানার সেই অংশকে ধৌত না করে নামাজ আদায় করা জায়েয নয়।
❖ হানাফি মাযহাবের বক্তব্য
হানাফি ফিকহ মতে, বীর্য শরীয়তে “নাজিস” (নাপাক)। অতএব যেখানে এটি লাগবে, সে স্থান বা বস্তুকে পরিশুদ্ধ করতে হবে।
📚 ইমাম কাসানি (রহ.) বলেন:
“وَالْمَنِيُّ نَجِسٌ عِنْدَ أَبِي حَنِيفَةَ وَمُحَمَّدٍ”
অর্থ: “ইমাম আবু হানিফা ও ইমাম মুহাম্মদের মতে, বীর্য নাপাক।” — (بدائع الصنائع، 1/84)
❖ কুরআনের দলিল
📖 القرآن
“وَإِن كُنتُمْ جُنُبًا فَاطَّهَّرُوا…”
অর্থ: “আর যদি তোমরা অপবিত্র (জানাবাতগ্রস্ত) হও, তবে ভালোভাবে পবিত্র হয়ে নাও।” — (সূরা আল-মায়িদাহ: ৬)
🔸 এই আয়াত দ্বারা বোঝা যায়, বীর্যপাত (ঘুমে হোক বা জাগরণে) জানাবাতের কারণ এবং এতে পবিত্রতা জরুরি হয়।
❖ হাদীসের দলিল
📗 হাদীস ১:
আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন:
“كُنتُ أَغسِلُ المَنِيَّ مِن ثَوبِ رسولِ اللَّهِ ﷺ، ثمَّ يَخرُجُ فيه إلى الصَّلاةِ وأنا أَنظُرُ إلى بُقَعِه”
অর্থ: “আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর কাপড় থেকে বীর্য ধুয়ে দিতাম, অতঃপর তিনি সেই কাপড় পরেই নামাজে যেতেন। আমি তখনও তাতে পানি লাগার দাগ দেখতে পেতাম।” — (সহীহ বুখারী: 229, সহীহ মুসলিম: 289)
🔸 এ হাদীস থেকে হানাফিরা প্রমাণ করেন যে, বীর্য কাপড়ে লাগলে তা ধুতে হয়; তা না করলে কাপড় নাপাক থেকে যাবে।
❖ বিছানার বিষয়ে হুকুম
যদি বীর্য বিছানায় পড়ে, এবং ঐ বিছানায় নামাজ আদায় বা ইবাদতের অন্য কোনো কাজ করা হয়, তাহলে:
- সেই অংশটি ধুয়ে ফেলতে হবে।
- অথবা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা বা অন্য জায়গায় নামাজ পড়তে হবে।
❖ শুকনো বীর্য কি শুধু ঘষে তুললেই হবে?
হানাফি মাযহাব মতে:
- তরল বা ভেজা অবস্থায় থাকলে ধুতে হবে।
- শুকিয়ে গেলে ঘষে ফেললেই চলবে না—তবুও ধুতে হবে।
📚 فتاوى عالمگيرى-তে আছে:
“المني نجس يجب غسله سواء كان رطبا أو يابسا”
অর্থ: “বীর্য নাপাক। তা ভেজা হোক বা শুকনো—উভয় অবস্থাতেই ধোয়া আবশ্যক।” — (الفتاوى الهندية، 1/45)
❖ নারীদের স্বপ্নদোষের হুকুম
হাদীস দ্বারা প্রমাণিত যে, নারীরাও স্বপ্নদোষে জানাবাতগ্রস্ত হয়।
📗 হাদীস:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন:
“نعم، فلتغتسل إذا رأت الماء”
অর্থ: “হ্যাঁ, (নারীও স্বপ্নদোষে) গোসল করবে, যদি বীর্যের চিহ্ন দেখতে পায়।” — (সহীহ বুখারী: 130, সহীহ মুসলিম: 313)
❖ সারসংক্ষেপ
বিষয় | হুকুম |
---|---|
কাপড়ে বীর্য লাগলে | ধুতে হবে; তা না হলে নামাজ সহীহ নয় |
বিছানায় বীর্য লাগলে | সেই অংশ পরিষ্কার করতে হবে বা নামাজে ব্যবহার না করতে হবে |
শুকনো বীর্য | ধোয়া আবশ্যক (হানাফি মতে) |
স্বপ্নদোষের পর গোসল | আবশ্যক (ফরজ) |
❖ উপসংহার
স্বপ্নদোষ একটি স্বাভাবিক বিষয়, এতে দুশ্চিন্তা বা লজ্জার কিছু নেই। বরং শরীয়তের নির্দেশনা মোতাবেক পবিত্রতা অর্জন করাই প্রকৃত মু’মিনের পরিচয়। তাই, স্বপ্নদোষের পর শুধু নিজের দেহ নয়, কাপড় ও বিছানাও যদি নাপাক হয়—তাহলে তা পরিশুদ্ধ করাই ইবাদতের পূর্বশর্ত।
🟢 প্রশ্নোত্তর: স্বপ্নদোষ ও পবিত্রতা
❓ ১. স্বপ্নদোষ হলে কি গোসল ফরজ হয়?
✅ হ্যাঁ, যদি বীর্যপাত হয়ে থাকে, তাহলে গোসল ফরজ হয়।
📖 হাদীস: নবী ﷺ বলেন,
“إذا أنزل أحدكم فليغتسل”
“তোমাদের কেউ বীর্যপাত করলে সে যেন গোসল করে।” — সহীহ মুসলিম: 343
❓ ২. স্বপ্নে উত্তেজনা অনুভব হলেও যদি কিছু বের না হয়, তাহলে কি গোসল ফরজ?
❌ না, যদি কোনো নির্গমন না ঘটে, তাহলে গোসল ফরজ নয়।
📖 হাদীসে এসেছে:
“إذا رأت الماء فلتغتسل” — “যদি পানি (বীর্য) দেখতে পায়, তবে গোসল করবে।” — সহীহ মুসলিম: 313
❓ ৩. স্বপ্নদোষ হলে শরীর কি নাপাক হয়?
✅ শরীরের যে অংশে বীর্য লেগেছে, কেবল সেই অংশ ধুয়ে ফেলতে হবে। পুরো শরীর জানাবাত অবস্থায়, তাই নামাজের জন্য সম্পূর্ণ শরীর ধুয়ে গোসল ফরজ হবে।
❓ ৪. স্বপ্নদোষের পর কখন গোসল করতে হবে?
- ✅ ঘুম থেকে উঠে বুঝতে পারলে, তখনই গোসল ফরজ হয়।
- ✅ ফজরের আগে বুঝতে পারলে, ফজরের আগে গোসল করে নামাজ পড়তে হবে।
- ✅ যদি সকালে উঠে বুঝে, তখন গোসল করে নিতে হবে—তার আগে নামাজ পড়া যাবে না।
❓ ৫. যদি কাপড় নাপাক হয়ে যায়, তাহলে কি সেটা পরে ঘুমানো যাবে?
✅ হ্যাঁ, ঘুমানো যাবে।
❌ তবে ঐ কাপড়ে নামাজ পড়া যাবে না, যতক্ষণ না তা ধোয়া হয়।
📚 নাপাক কাপড়ে ঘুমানোতে গুনাহ নেই, কিন্তু নামাজে পবিত্র কাপড় পরা ফরজ।
❓ ৬. কাপড় বা বিছানায় বীর্য লাগলে কী করণীয়?
✅ ঐ অংশ ধুয়ে ফেলতে হবে।
✅ অথবা পরিষ্কার স্থানে নামাজ পড়তে হবে।
❓ ৭. কাপড়ে শুকনো বীর্য থাকলে কী করতে হবে?
✅ হানাফি মাযহাব মতে, শুকনো হলেও ধুতে হবে।
📚 ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া: “المني نجس يجب غسله سواء كان رطبا أو يابسا”
❓ ৮. নারীদের স্বপ্নদোষ হলে কি গোসল ফরজ?
✅ হ্যাঁ, যদি নির্গমন ঘটে।
📖 হাদীস: “نعم، إذا رأت الماء” — “হ্যাঁ, যদি পানি (বীর্য) দেখে, তবে গোসল করবে।” — সহীহ মুসলিম: 313
❓ ৯. জানাবাত অবস্থায় কুরআন স্পর্শ করা যাবে কি?
❌ না, জানাবাত অবস্থায় কুরআন স্পর্শ করা হারাম।
📖 “لَا يَمَسُّهُ إِلَّا الْمُطَهَّرُونَ” — “এতে কেবল পবিত্ররাই স্পর্শ করতে পারে।” — সূরা আল-ওয়াকিআহ: ৭৯
❓ ১০. স্বপ্নদোষ স্বাভাবিক বিষয় কি না?
✅ হ্যাঁ, এটি প্রাকৃতিক এবং স্বাভাবিক। এতে গুনাহ নেই। তবে শরীয়তের নিয়ম মেনে পবিত্রতা রক্ষা করতে হবে।