আমরা আমাদের জীবনের প্রতিটি ধাপে আল্লাহ তায়ালার মুখাপেক্ষী। মহান আল্লাহ ব্যতীত আমাদের জন্য কোনো সাহয্যকারী নেই। আমরা আল্লাহ তায়ালার কাছে সাহয্য চাইতে অনেক বাক্য ব্যবহার করি। সে সব দোয়ার মধ্যথেকে একটি হল – আগিসনি ইয়া রাহমান। আপনাদের অনেকে এই বাক্যটির অর্থ কি? এটি কোনো হাদিসে আছে কি না? এই দোয়াটির উপকারীতা বা ফজিলত কী ইত্যাদি জানতে চেয়ে প্রশ্ন করেন।
আমরা এই পোস্টে আগিসনি ইয়া রাহমান এই দোয়াটির অর্থ কি? শব্দটির বিশ্লেষণ ও তার সাথে প্রাসঙ্গিক সকল দিক নিয়ে আলোচনা করব। এটা আপনাকে আপনার জ্ঞানকে আরো সমৃদ্ধ করতে এবং সর্বোত্তম উপায়ে আল্লাহর কাছে সাহয্য চাইতে অনুপ্রেরণা দিবে।
আগিসনি ইয়া রাহমান অর্থ কি?
আগিসনি ইয়া রাহমান বাক্যটির আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে – আমাকে সাহায্য করুন হে রাহমান (দয়াময়, এটি মহান আল্লাহ তায়ালাল একটি গুণবাচক নাম)। তবে যে কোনো দোয়ার অর্থ ভালোভাবে বুঝার ক্ষেত্রে মূল আবরি দেখে নেওয়া বেশ ফলপ্রসূ। তাই আমরা নিচে এই দোয়াটির আরবি রূপ লিখে ও তার বিশ্লেষণ করছি।
দোয়াটির আরবি রূপ
أغِثنِیٛ یَا رَحٛمٰن
উচ্চারণ: আগিসনি ইয়া রাহমান।
অনুবাদ: আমাকে সাহায্য করুন হে রাহমান (দয়াময়)।
ব্যাকরণগত বিশ্লেষণ
আগিসনি ( أغِثنِیٛ ) এই অংশটি আগিস শব্দটি الإغاثة) ক্রিয়ামূল থেকে আদেশ বা অনুরোধমূলক বাক্য। এর সাথে যুক্ত হয়েছে উত্তম পুরুষ ( ইয়া মুতাকাল্লিম )। বাক্যটির অর্থ হল আমাকে সাহায্য করুন।
ইয়া রাহামান ( یَا رَحٛمٰن ) এই অংশটি ইয়া সম্বোধনবাচক বর্ণ ও রাহামান – আল্লাহ তায়ালার গুণবাচক নাম নিয়ে ঘটিত। ইয়া রাহমান মানে হচ্ছে, হে দয়াময়।
আগিসনি ইয়া রাহমান দোয়া ও হাদিস
কোনো সহিহ হাদিসে আগিসনি ইয়া রামহান শব্দটি এভাবে আমরা পাইনি। একটি হাদিসে ‘ইয়া মুগিসা আগিসনি’ বাক্যাংশটি আছে। তবে সেই হাদিসটি বিশুদ্ধ নয়। তবে এই দোয়াটির অর্থ ভালো। তাই এটি আপনি চাইলে করতে পারেন। এতে কোনো অসুবিধা হবে না। কিন্তু এটা মনে রাখতে হবে এই দোয়াটি মাসনুন দোয়া হিসাবে বিশ্বাস করা যাবে না।
উপকারীতা
অনেক মানুষ বলেন তিনবার আগিসনি ইয়া রাহমান বলে দোয়া করলে যে কোনো দোয়া কবুল হয়। কিন্তু যেহেতেু এই কথা প্রমাণকারী কোনো সহিহ হাদিস নেই। তাই আমরা তাদের এই কথাটি বিশ্বাস করব না। তবে যেহেতু এটি একটি দোয়া তাই সাধারণ কিছু উপকার আমরা লাভ করতে পারি।
এই দোয়াটি একটি সংক্ষিপ্ত এবং অত্যন্ত পরিচিত দোয়া। যা আল্লাহ তায়ালার সাহায্যের জন্য পাঠ করা হয়। এর কিছু সাধারণ উপকার নীচে উল্লেখ করা হলো:
আল্লাহর রহমত লাভ: এই দোয়ার মাধ্যমে একজন মুমিন আল্লাহর রহমত প্রার্থনার দ্বারা তার জীবনের বিভিন্ন কঠিন সময়ে আল্লাহর সহায়তা এবং আশ্রয় লাভ করেন।
মনের প্রশান্তি: এই দোয়া পাঠের মাধ্যমে যে কোনো ব্যক্তি তার প্রশান্তি লাভ করেন এবং মানসিক চাপ কমাতে পারেন। এটি আমাদের হৃদয়ে সান্ত্বনা এবং স্থিরতা প্রদান করে।
আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি: যখন একজন মুমিন এই দোয়া পাঠ করে, তার আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পায়, কারণ সে বিশ্বাস করে যে আল্লাহ তার সাহায্যকারী এবং রক্ষাকারী।
আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়া: এই দোয়া একজন ব্যক্তিকে আল্লাহর আরও নিকটবর্তী করে তোলে, যা তার ঈমান এবং তাকওয়া বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়।
পরিস্থিতির উন্নতি: এই দোয়ার বরকতে একজন মুমিনের জীবনের বিভিন্ন পরিস্থিতি এবং সমস্যা সমাধানের পথ সহজ হয়ে যায়। কারণ আল্লাহ তার কৃপায় সমস্ত অসুবিধা দূর করতে পারেন।
একটি ঘটনা ও ইতিবৃত্ত
আমরা আগেই বলেছি আগিসনি ইয়া রাহমান এই দোয়াটি হাদিসে সরাসরি উল্লেখ নেই । তবে একটি ইসরায়েলি বর্ণনা রয়েছে আমরা সেটি উল্লেখ করছি।
يا ودود يا ودود، يا ذا العرش المجيد، يا مبدئ يا معيد، يا فعالا لما يريد، أسألك بنور وجهك الذي ملأ أركان عرشك، وأسألك بقدرتك التي قدرت بها على جميع خلقك، وأسألك برحمتك التي وسعت كل شيء، لا إله إلا أنت، يا مغيث أغثني
অনুবাদ: প্রেমময়, পরম স্নেহশীল, হে মহিমান্বিত আরশের অধিপতি, হে সমস্ত সৃষ্টির স্রষ্টা এবং পুনরুদ্ধারকারী। হে (মহান সত্তা) যিনি যা ইচ্ছা করেন তা সম্পন্ন করেন। আমি আপনার সেই সত্তার নূরের ওসিলায় প্রার্থনা করছি, যা আপনার আরশের সকল স্তর পূর্ণ করে রেখেছে। আমি আপনার সেই ক্ষমতার ওসিলায় প্রার্থনা করছি, যা দ্বারা আপনি সমস্ত সৃষ্টির উপর ক্ষমতাবান। আমি আপনার সেই দয়ার ওসিলায় প্রার্থনা করছি, যা সমস্ত কিছুকে ঘিরে রেখেছে। আপনি ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই। হে সাহায্যকারী, আমাকে সাহায্য করুন।
আগিসনি ইয়া রাহমান দোয়াটির ক্ষেত্রে এই হাদিসটি অনেকে বর্ণনা করেন।
আগিসনি ইয়া রাহমান দোয়ার মূল গল্প
আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: “নবী (সাঃ)-এর একজন সাহাবী, যার নাম ছিল আবু মুলাইক। তিনি একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি অন্যের পুঁজিতে ব্যবসা করতেন। তিনি অত্যন্ত ধার্মিক ও পরহেজগার ছিলেন।
একবার তিনি ব্যবসার জন্য সফরে বের হন এবং পথে এক সশস্ত্র ডাকাতের সাথে সাক্ষাৎ হয়। ডাকাত তাকে বলল, ‘তোমার কাছে যা আছে তা রেখে দাও, আমি তোমাকে হত্যা করব।’ তিনি বললেন, ‘তুমি আমার রক্ত কেন নিতে চাও? যা তোমার দরকার তা নিয়ে যাও।’
ডাকাত বলল, ‘অর্থ তো আমারই হবে, আমি তোমার রক্তই চাই।’ তখন সাহাবী বললেন, ‘যদি তুমি তা চেয়েই থাকে, তবে আমাকে চার রাকাত নামাজ পড়তে দাও।’ ডাকাত বলল, ‘তুমি যা ইচ্ছা পড়ো।’
সাহাবী ওজু করে চার রাকাত নামাজ পড়লেন এবং শেষ সেজদায় উল্লেখিত দোয়াটি করলেন:
তিনবার দোয়াটি করার পর, তিনি দেখতে পেলেন একজন অশ্বারোহী যোদ্ধা, যার হাতে একটি বর্শা এবং তা তার ঘোড়ার কান পর্যন্ত উঁচু। সে এসে ডাকাতকে বর্শা দিয়ে হত্যা করল। তারপর সাহাবীর কাছে এসে বলল, ‘উঠুন।’ সাহাবী বললেন, ‘আপনি কে? আমার মা-বাবা আপনার ওপর কুরবান হোক, আল্লাহ আজ আপনাকে আমার সাহায্যে পাঠিয়েছেন।’
তিনি বললেন, ‘আমি চতুর্থ আসমানের একজন ফেরেশতা। আপনি যখন প্রথমবার দোয়া করলেন, তখন আসমানের দরজাগুলোতে আওয়াজ শুনলাম। দ্বিতীয়বার দোয়া করার পর আসমানে হৈচৈ শুনলাম। তৃতীয়বার দোয়া করার পর বলা হলো, ‘একজন বিপদগ্রস্তের দোয়া’, তারপর আমি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলাম যে, আমাকে তাকে হত্যা করার দায়িত্ব দিন।’
আনাস (রাঃ) বলেন: ‘জেনে রাখুন, যে ব্যক্তি ওজু করে চার রাকাত নামাজ পড়বে এবং এই দোয়া করবে, আল্লাহ তার বিপদ দূর করবেন, সে বিপদে থাকুক বা না থাকুক।’
মতামত
ইসলাম কিউএ ওয়েব সাইটে এই হাদিস ও দোয়া সম্পর্কে বলা হয়-
গল্প ও হাদিস কোনোভাবেই সঠিক নয়। তবে, এই দোয়ার বাক্যাংশ এবং শব্দগুচ্ছগুলোর মধ্যে কোনো অসঙ্গতি নেই; বরং এর কথাগুলো সঠিক এবং মহান, যা কুরআন এবং হাদিসের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। তবে, এ কথা বিশ্বাস করা যাবে না যে, কেউ এই দোয়া করলে অবশ্যই রক্ষা পাবে বা আল্লাহ তায়ালা তাকে সাহায্য করবেন।
কারণ এটি নির্ভর করে সঠিক সনদ দ্বারা প্রমাণিত হওয়ার ওপর। যেহেতু এই দোয়ার সনদ সঠিক নয়, তাই এটিকে শরিয়তের সঙ্গে সম্পর্কিত মনে করা উচিত নয়। কেউ যদি এই কথাগুলো মুখস্থ করে দোয়া করতে চায় তবে কোনো সমস্যা নেই, ইনশাআল্লাহ। তবে, এটিকে শরিয়তের অংশ হিসেবে দাবি করা উচিত নয়।