রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি প্রেরিত দুরুদগুলোর মধ্যে থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দুরুদ হল আল্লাহুম্মা সাল্লি ওয়া সাল্লিম আলা নাবিয়্যিনা মুহাম্মাদ। এটির দ্বারা মূলত নবী মুহাম্মাদ (সা.) এর জন্য আল্লাহর রহমত এবং শান্তি প্রার্থনা করা হয়। এই প্রবন্ধে, আমরা এই দুরুদের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করব, এর অর্থ, গুরুত্ব, উচ্চারণ, অনুবাদ এবং সাধারণ জিজ্ঞাসার উত্তর দেব।
আল্লাহুম্মা সাল্লি ওয়া সাল্লিম আলা নাবিয়্যিনা মুহাম্মাদ কী?
আল্লাহুম্মা সাল্লি ওয়া সাল্লিম আলা নাবিয়্যিনা মুহাম্মাদ হল নবী মুহাম্মাদ (সা.) এর প্রতি প্রেরিত একটি দরূদ। এটি নবী সা. এর প্রতি সম্মান ও ভালোবাসা প্রদর্শনের একটি বিশেষ মাধ্যম। আমরা এই দরূদ পাঠ করে নবীর প্রতি তাদের ভালোবাসা ও সম্মান প্রকাশ করে।
আরবি পাঠ
“আল্লাহুম্মা সাল্লি ওয়া সাল্লিম আলা নাবিয়্যিনা মুহাম্মাদ” দোয়ার আরবি পাঠ হল:
اللَّهُمَّ صَلِّ وَسَلِّمْ عَلَى نَبِيِّنَا مُحَمَّدٍ
অর্থ: হে আল্লাহ, আমাদের নবী মুহাম্মাদ (সা.) এর উপর আপনি শান্তি ও আশীর্বাদ প্রেরণ করুন।”
উচ্চারণ গাইড
যারা আরবি উচ্চারণের সাথে পরিচিত নন তাদের জন্য একটি সহজ গাইড:
- আল্লাহুম্মা: আল-লাহ-হুম-মা
- সাল্লি: সাল-লি
- ওয়া: ওয়া
- সাল্লিম: সাল-লিম
- আলা: আ-লা
- নাবিয়্যিনা: না-বি-ই-ই-না
- মুহাম্মাদ: মু-হাম-মাদ
অনুবাদ
এই দোয়ার সম্পূর্ণ অনুবাদ হল: “হে আল্লাহ, আমাদের নবী মুহাম্মাদ (সা.) এর উপর আপনার শান্তি ও আশীর্বাদ প্রেরণ করুন।” এটি একটি শক্তিশালী দোয়া যা মুসলমানদের হৃদয়ে গভীর ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা জাগায়।
ইসলামে দরূদের গুরুত্ব ও ফজিলত
ইসলামে দরূদ পাঠ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও ফজিলতময় একটি ইবাদত। নবী মুহাম্মাদ (সা.) বলেছেন যে, যারা তার উপর দরূদ পাঠ করে, আল্লাহ তাদের উপর দশটি রহমত পাঠান। এটি মুসলমানদের হৃদয়ে আল্লাহ এবং তার নবীর প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা জাগায়।
কুরআনের আয়াত ও হাদিস
কুরআনের আয়াত
আল্লাহ তাআলা কুরআনে মজিদে সরাসরি নবী মুহাম্মাদ (সা.) এর উপর দরূদ ও সালাম পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন। কুরআনের সূরা আল-আহযাবের ৫৬ নাম্বার আয়াতে বলা হয়েছে:
إِنَّ اللَّهَ وَمَلَائِكَتَهُ يُصَلُّونَ عَلَى النَّبِيِّ ۚ يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا صَلُّوا عَلَيْهِ وَسَلِّمُوا تَسْلِيمًا
উচ্চারণ: “ইন্নাল্লাহা ওয়া মালা’ইকাতাহু ইউসাল্লুনা ‘আলা নাবিয়্যি, ইয়া আয়্যুহাল্লাযীনা আমানূ সাল্লু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লিমূ তাসলীমা।”
অনুবাদ: “নিশ্চয়ই আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতারা নবীর উপর দরূদ পাঠান। হে ঈমানদারগণ! তোমরা তার প্রতি দরূদ ও সালাম প্রেরণ করো।”
হাদিস
নবী মুহাম্মাদ (সা.) দরূদ পাঠ করার ফজিলত সম্পর্কে বহু হাদিস বর্ণনা করেছেন। নিচে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য হাদিস দেওয়া হলো:
১. দরূদ পাঠে দশটি রহমত
হাদিস: “যে ব্যক্তি আমার উপর একবার দরূদ পাঠ করে, আল্লাহ তার উপর দশটি রহমত পাঠান।”
তথ্যসূত্র:
- মুসলিম শরীফ
২. দরূদ পাঠে গুনাহ মাফ
হাদিস: “যে ব্যক্তি আমার উপর দরূদ পাঠ করে, তার পাপ মোচন হয় এবং তার মর্যাদা বৃদ্ধি পায়।”
তথ্যসূত্র:
- তিরমিজি
৩. কিয়ামতের দিনে নিকটবর্তী হওয়া
হাদিস: “কিয়ামতের দিন আমার নিকটতম ব্যক্তি হবে যে সবচেয়ে বেশি দরূদ পাঠ করেছে।”
তথ্যসূত্র:
- তিরমিজি
৪. প্রার্থনা কবুল হওয়া
হাদিস: “যে ব্যক্তি আমার উপর দরূদ পাঠ করে তার দোয়া কবুল হয়।”
তথ্যসূত্র:
- তাবারানি
৫. শাফায়াত পাওয়া
হাদিস: “যে ব্যক্তি আমার উপর দরূদ পাঠ করে, আমি কিয়ামতের দিন তার শাফায়াত করব।”
তথ্যসূত্র:
- সহিহ বুখারি
দরূদ পাঠের সময়
দরূদ যে কোনো সময় পাঠ করা যেতে পারে, তবে বিশেষ সময়গুলিতে এটি পাঠ করা অত্যন্ত পুণ্যের কাজ। যেমন:
- নামায শেষে।
- আজান ও ইকামতের মধ্যে।
- জুমার দিন।
- কুরআন পাঠের পরে।
- দিনের যে কোনো সময়।
দরূদ পাঠের উপকারিতা
- আধ্যাত্মিক উপকারিতা: এটি আল্লাহর সাথে সংযোগ বৃদ্ধি করে এবং নবীর প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা জাগায়।
- আবেগিক উপকারিতা: এটি মনকে শান্তি দেয় এবং হৃদয়ে আনন্দের অনুভূতি জাগায়।
- পুণ্যের কাজ: দরূদ পাঠ করা একটি পুণ্যের কাজ যা আল্লাহর কাছে অত্যন্ত প্রিয়।
দরূদের প্রকারভেদ
দরূদ শরীফের বিভিন্ন প্রকার আছে। আল্লাহুম্মা সাল্লি ওয়া সাল্লিম আলা নাবিয়্যিনা মুহাম্মাদ এর পাশাপাশি আরও কিছু জনপ্রিয় দরূদ আছে যেমন:
- দরূদ ইব্রাহিমি
اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا صَلَّيْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ وَعَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ
اللَّهُمَّ بَارِكْ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا بَارَكْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ وَعَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ
উচ্চারণ: “আল্লাহুম্মা ছল্লি আলা মুহাম্মাদিন ওয়া আলা আলি মুহাম্মাদিন কামা ছাল্লাইতা আলা ইবরাহিমা ওয়া আলা আলি ইবরাহিমা ইন্নাকা হামিদুম মজিদ।
আল্লাহুম্মা বারিক আলা মুহাম্মাদিন ওয়া আলা আলি মুহাম্মাদিন কামা বারাকতা আলা ইবরাহিমা ওয়া আলা আলি ইবরাহিমা ইন্নাকা হামিদুম মজিদ।”
- দুরুদে দাজরজত
اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ وَارْزُقْنَا مُرَافَقَتَهُ فِي الْجَنَّةِ وَاجْعَلْنَا فِي زُمْرَتِهِ وَارْزُقْنَا شَفَاعَتَهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ
উচ্চারণ: “আল্লাহুম্মা ছল্লি আলা মুহাম্মাদিন ওয়া আলা আলি মুহাম্মাদিন ওয়ারযুকনা মুরাফাকাতাহু ফিল জান্নাহ ওয়াজ’আলনা ফি জুমরাতিহি ওয়ারযুকনা শাফাআতাহু ইয়াওমাল কিয়ামাহ।”
দরূদ পাঠের ইতিহাস
দরূদ পাঠের ঐতিহ্য নবী মুহাম্মাদ (সা.) এর সময় থেকে চলে আসছে। তিনি নিজেও তার উপর দরূদ পাঠ করতে উম্মতকে উৎসাহিত করেছেন। এটি তার প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা প্রদর্শনের একটি বিশেষ মাধ্যম।
সাধারণ জিজ্ঞাসা
১. দরূদ পাঠের জন্য কি কোনো নির্দিষ্ট সংখ্যা আছে?
না, দরূদ যে কোনো পরিমাণে পাঠ করা যেতে পারে। তবে বেশি পরিমাণে পাঠ করা পুণ্যময়।
২. দরূদ কি শুধুমাত্র আরবিতেই পাঠ করা উচিত?
হ্যাঁ, মূল দরূদ আরবিতেই পাঠ করা উচিত, তবে অর্থ বুঝার জন্য অনুবাদ পড়া যেতে পারে।
৩. দরূদ কি শুধুমাত্র প্রার্থনার সময় পাঠ করা উচিত?
না, দরূদ যে কোনো সময়, যে কোনো স্থানে পাঠ করা যেতে পারে।
৪. দরূদ পাঠ করার মাধ্যমে কি গুনাহ মাফ হয়?
হ্যাঁ, নবী মুহাম্মাদ (সা.) বলেছেন যে, যারা তার উপর দরূদ পাঠ করে, তাদের গুনাহ মাফ হয়।
৫. দরূদ কি মহিলারা পাঠ করতে পারে?
হ্যাঁ, দরূদ পুরুষ ও মহিলা উভয়ের জন্যই প্রযোজ্য।
উপসংহার
“আল্লাহুম্মা সাল্লি ওয়া সাল্লিম আলা নাবিয়্যিনা মুহাম্মাদ” একটি গুরুত্বপূর্ণ দোয়া যা মুসলমানদের হৃদয়ে নবী মুহাম্মাদ (সা.) এর প্রতি গভীর ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা জাগায়। এই দোয়ার অর্থ, উচ্চারণ এবং গুরুত্ব বোঝার মাধ্যমে, মুসলমানরা তাদের আধ্যাত্মিক অনুশীলন বৃদ্ধি করতে এবং নবীর প্রতি তাদের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা প্রদর্শনের মাধ্যম। আল্লাহ আমাদের সবাইকে নবী মুহাম্মাদ (সা.) এর প্রতি গভীর ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা প্রদানের তাওফিক দিন। আমিন।
আরো পড়ুন: