আস্তাগফিরুল্লাহ ইন্নাল্লাহা গাফুরুর রাহিম । অর্থ । ফজিলত ও একটি গল্প

পোস্টটি শেয়ার করুন

মানবজীবনে ভুল ও ত্রুটি অবশ্যম্ভাবী। আমরা প্রতিদিন এমন অনেক কাজ করি, যা আমাদের প্রভুর অসন্তুষ্টির কারণ হতে পারে। কিন্তু আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা আমাদের প্রতি অশেষ দয়ালু। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ নিজেকে “গাফুরুর রাহিম” (অতিমাত্রায় ক্ষমাশীল এবং পরম দয়ালু) বলে পরিচয় দিয়েছেন। এই গুণাবলি আমাদের আশার আলো দেখায় এবং আমাদের ক্ষমাপ্রার্থনার জন্য উৎসাহিত করে। “আস্তাগফিরুল্লাহ ইন্নাল্লাহা গাফুরুর রাহিম” এমনই একটি বাক্য, যা আমাদের প্রভুর কাছে ক্ষমার আবেদন করার এক সুন্দর পন্থা।

আস্তাগফিরুল্লাহ ইন্নাল্লাহা গাফুরুর রাহিম । আরবি ও অর্থ

আরবি:

أَسْتَغْفِرُ اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ

উচ্চারণ: আস্তাগফিরুল্লাহ ইন্নাল্লাহা গাফুরুর রাহিম।

বাংলা অর্থ:“আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। নিশ্চয়ই আল্লাহ অতিমাত্রায় ক্ষমাশীল এবং পরম দয়ালু।”

আস্তাগফিরুল্লাহ ইন্নাল্লাহা গাফুরুর রাহিম
বিশেষ তাসবিহ: আস্তাগফিরুল্লাহ ইন্নাল্লাহা গাফুরুর রাহিম

আস্তাগফিরুল্লাহ: ক্ষমাপ্রার্থনার মানে । বিশ্লেষণ

“আস্তাগফিরুল্লাহ” শব্দের অর্থ হলো, “আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।” এটি আমাদের গুনাহের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়ার এবং তাঁর কাছে ফিরে আসার একটি সরল ও আন্তরিক আবেদন। কুরআন ও হাদিসে বারবার ইসতেগফারের (ক্ষমাপ্রার্থনার) গুরুত্ব উল্লেখ করা হয়েছে। ইসতেগফার শুধু আমাদের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে না, এটি আমাদের জীবনের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানেও সাহায্য করে।

কুরআনের আলোকে ইসতেগফারের গুরুত্ব

আল্লাহ বলেন:

“তোমরা তোমাদের প্রভুর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর এবং তাঁর দিকে ফিরে আসো। তিনি আকাশ থেকে তোমাদের জন্য প্রচুর বৃষ্টি বর্ষণ করবেন এবং তোমাদের সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি বৃদ্ধি করবেন।”
(সূরা হুদ: ৩)

এই আয়াত থেকে বোঝা যায়, ইসতেগফার আমাদের আধ্যাত্মিক এবং বস্তুগত জীবনের জন্যও আশীর্বাদ নিয়ে আসে।

ইন্নাল্লাহা গাফুরুর রাহিম: আল্লাহর দয়ার পরিচয়

“ইন্নাল্লাহা গাফুরুর রাহিম” অর্থ হলো, “নিশ্চয়ই আল্লাহ অতিমাত্রায় ক্ষমাশীল এবং পরম দয়ালু।” আল্লাহর এই গুণাবলি তাঁর প্রতি আমাদের আস্থা ও ভালোবাসা বাড়ায়। মানুষ ভুল করবে—এটা তার প্রকৃতি। কিন্তু আল্লাহ আমাদের তাওবার মাধ্যমে শুদ্ধ হওয়ার সুযোগ দিয়েছেন।

হাদিসে ক্ষমাশীলতার উদাহরণ

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:

“প্রতিদিন রাতে যখন শেষ তৃতীয়াংশ বাকি থাকে, তখন আমাদের প্রভু পৃথিবীর আকাশে অবতরণ করেন এবং বলেন, ‘কে আমাকে ডাকবে, আমি তার ডাকে সাড়া দেব। কে আমার কাছে ক্ষমা চাইবে, আমি তাকে ক্ষমা করব।'” (সহীহ বুখারি, সহীহ মুসলিম)

এই হাদিস থেকে বোঝা যায়, আল্লাহ আমাদের তাওবার অপেক্ষায় থাকেন। তাঁর দয়া এতটাই মহান যে, তিনি আমাদের অন্তরের গভীরতম অনুশোচনাও গ্রহণ করেন।

তাওবা ও ইসতেগফারের প্রভাব আমাদের জীবনে

ইসতেগফার আমাদের জীবনে অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে। এর মাধ্যমে আমরা কেবল আল্লাহর কাছে ক্ষমা লাভ করি না, বরং আমাদের মনও শান্তি পায়।

১. আত্মার পরিশুদ্ধতা: ইসতেগফার গুনাহের বোঝা কমিয়ে দেয় এবং আমাদের হৃদয়কে আল্লাহর দিকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। এটি আমাদের আত্মাকে শুদ্ধ করে এবং ইবাদতে মনোযোগ বাড়ায়।

২. জীবনের সমস্যার সমাধান: কুরআনে উল্লেখ রয়েছে যে, ইসতেগফার আমাদের জীবনের নানা সমস্যার সমাধান এনে দেয়। অর্থনৈতিক কষ্ট, মানসিক অস্থিরতা, বা অন্য কোনো সমস্যায় ইসতেগফার আল্লাহর রহমত লাভের মাধ্যম হতে পারে।

৩. সম্পর্কের উন্নতি: ইসতেগফার আমাদের অন্যায়ের জন্য শুধু আল্লাহর কাছেই নয়, মানুষের কাছেও ক্ষমা চাইতে অনুপ্রাণিত করে। এর ফলে মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক আরও মজবুত হয়।

৪. দুনিয়া ও আখিরাতের সফলতা: ইসতেগফার দুনিয়ায় সুখ এবং আখিরাতে মুক্তির উপায়। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি ইসতেগফারে লিপ্ত থাকে, আল্লাহ তাকে প্রতিটি বিপদ থেকে মুক্তি দেবেন এবং অপ্রত্যাশিত উৎস থেকে রিজিক প্রদান করবেন।” (আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ)

কীভাবে ইসতেগফার করা উচিত?

ইসতেগফার শুধুমাত্র কথায় সীমাবদ্ধ নয়, এর মধ্যে আন্তরিকতা থাকা জরুরি। এখানে কিছু ধাপ তুলে ধরা হলো:

  • গুনাহ স্বীকার করা: নিজের ভুলগুলো উপলব্ধি করা এবং আল্লাহর কাছে তা স্বীকার করা।
  • আন্তরিক অনুশোচনা: ভুলের জন্য গভীরভাবে অনুশোচনা করা।
  • ভবিষ্যতে এড়ানোর প্রতিশ্রুতি: একই গুনাহ পুনরায় না করার দৃঢ় সংকল্প করা।
  • ইবাদত ও দোয়া: ইসতেগফারের পাশাপাশি নামাজ পড়া, কুরআন তিলাওয়াত করা এবং আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা।

ইসতেগফারের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দোয়া

১. সাইয়েদুল ইসতেগফার:

“আল্লাহুম্মা আনতা রাব্বি লা ইলাহা ইল্লা আনতা খালাকতানি ওয়া আনা আবদুকা ওয়া আনা আলা আহদিকা ওয়া ওয়াদিকা মাসতাতাতু, আউযু বিকা মিন শারি মা সানাতু। আবুউ লাকা বিনি’মাতিকা আলাইয়া ওয়া আবুউ বিনাম্বি ফাগফিরলি ফাইন্নাহু লা ইয়াগফিরুজ্জুনুবা ইল্লা আন্তা।” (বুখারি)

২. সংক্ষিপ্ত ইসতেগফার :

“আস্তাগফিরুল্লাহ ওয়া আতুবু ইলাইহি।”

(আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই এবং তাঁর দিকে ফিরে আসি।)

ইন্নাল্লাহা গাফুরুর রাহিম ও একটি ছোট গল্প

একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবিদের সামনে একটি চমৎকার উদাহরণ তুলে ধরলেন। তিনি বললেন:

**“এক ব্যক্তি মরুভূমিতে ভ্রমণ করছিল। তার সাথে তার উট ছিল, উটের ওপর তার খাবার-পানীয় ছিল। একসময় সে এক গাছের নিচে বিশ্রাম করতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুম থেকে জেগে দেখে, তার উটটি হারিয়ে গেছে। উটসহ খাবার হারিয়ে সে ভীষণ হতাশ হয়ে পড়ে।

মরুভূমির তীব্র গরম ও ক্ষুধায় মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, সে আল্লাহর কাছে ক্ষমা ও সাহায্য প্রার্থনা করতে থাকে। ঠিক সেই মুহূর্তে, হঠাৎ করে সে তার উটটিকে নিজের সামনে দেখতে পায়।

আনন্দে আত্মহারা হয়ে সে বলে ওঠে: ‘হে আল্লাহ! তুমি আমার বান্দা, আর আমি তোমার প্রভু।’ (অতিরিক্ত আনন্দে সে ভুল করে এই কথা বলে ফেলে)।”

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, “আল্লাহ তার বান্দার তাওবা কবুল করলে এতটাই খুশি হন, যতটা খুশি ওই ব্যক্তি তার উট ফিরে পেয়ে হয়েছিল।” (সহীহ বুখারী : ৬৩০৯ ও সহীহ মুসলিম: ২৭৪৭)

এই গল্পের শিক্ষা:

১. আল্লাহ তাআলা অত্যন্ত ক্ষমাশীল এবং দয়ালু।
২. আমরা যত বড় পাপই করি না কেন, আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইলে তিনি ক্ষমা করে দেন।
৩. আল্লাহর প্রতি আমাদের বিশ্বাস রাখতে হবে এবং সবসময় তাঁর কাছে ক্ষমা ও সাহায্য প্রার্থনা করতে হবে।

কিছু প্রশ্ন কিছু উত্তর

১. কতবার ইসতেগফার করা উচিত?

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) দিনে অন্তত ৭০ থেকে ১০০ বার ইসতেগফার করতেন। তবে আমাদের জন্য সংখ্যার চেয়ে আন্তরিকতা গুরুত্বপূর্ণ।

২. ইসতেগফার কি শুধু গুনাহের পর করতে হবে?

না। ইসতেগফার শুধু গুনাহের পর নয়, প্রতিদিন নিয়মিত করা উচিত। এটি আল্লাহর নৈকট্য লাভের অন্যতম উপায়।

৩. যদি একই গুনাহ বারবার হয়ে যায়, তবে কি ইসতেগফার গ্রহণ হবে?

আল্লাহর দয়া অসীম। যদি আপনি আন্তরিকভাবে তাওবা করেন, আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করবেন, যদিও বারবার গুনাহ হয়ে থাকে। তবে একই গুনাহ থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়া জরুরি।

৪. ইসতেগফার কি দুনিয়াবী সমস্যার সমাধান এনে দেয়?

হ্যাঁ। কুরআন ও হাদিসে উল্লেখ রয়েছে যে, ইসতেগফার জীবনের নানা সমস্যার সমাধান এনে দেয় এবং বরকত বৃদ্ধি করে।

উপসংহার

“আস্তাগফিরুল্লাহ ইন্নাল্লাহা গাফুরুর রাহিম” কেবল একটি বাক্য নয়, এটি আমাদের জীবনের পথপ্রদর্শক। এটি আমাদের আল্লাহর রহমত এবং দয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ইসতেগফারের মাধ্যমে আমরা গুনাহ থেকে মুক্তি পেতে পারি এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে পারি। আসুন, প্রতিদিনের জীবনে ইসতেগফারকে অন্তর্ভুক্ত করি এবং আল্লাহর অসীম দয়া ও ক্ষমার আশ্রয় গ্রহণ করি।

আল্লাহ আমাদের সবাইকে তাওবা করার তাওফিক দান করুন এবং ক্ষমা করুন। আমীন।


পোস্টটি শেয়ার করুন