জীবনের প্রতিটি মুহূর্তেই আমরা আল্লাহর দরজায় মুখাপেক্ষী। কখনো রিজিকের প্রয়োজনে, কখনো নিরাপত্তার আশায়, আবার কখনো হৃদয়ের প্রশান্তি কামনায় আমরা মুখ তুলে তাকাই আমাদের স্রষ্টার দিকে। এ দুনিয়ার যাবতীয় চাওয়া-পাওয়ার সবচেয়ে নিরাপদ ঠিকানা হলো আল্লাহ রাব্বুল আলামিন। আর এই চাওয়ার অন্যতম সরল, অথচ গভীর অর্থবহ একটি দোয়া হলো – আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা মিন ফাদলিক:
اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ مِنْ فَضْلِكَ
“হে আল্লাহ, আমি আপনার অনুগ্রহ চাই।”
এই সংক্ষিপ্ত বাক্যের মধ্যেই লুকিয়ে আছে এক মুমিনের বিনয়, চাওয়ার ধরন ও আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা। এই দোয়া শুধুই একটি বাক্য নয়—এটি এক আত্মিক দিকনির্দেশনা, যা আমাদের শেখায় কিভাবে আমরা আল্লাহর ফজল কামনা করবো এবং কোন পরিস্থিতিতে এটি পাঠ করবো।
আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা মিন ফাদলিক — এক অনন্য চাওয়ার ভাষা
📖 দোয়ার আরবি, বাংলা উচ্চারণ ও অর্থ
اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ مِنْ فَضْلِكَ
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা মিন ফাদলিক
অর্থ: হে আল্লাহ, আমি আপনার অনুগ্রহ চাই।
🧠 দোয়ার শব্দ বিশ্লেষণ
১. اللَّهُمَّ
🔹 অর্থ: হে আল্লাহ!
🔹 মূল শব্দ: “اللَّه” (আল্লাহ) — একমাত্র উপাস্য।
🔹 তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ:
“اللَّهُمَّ” হচ্ছে “اللَّه” শব্দে نُداء (সম্বোধন) এবং ميم الدعاء যুক্ত হয়ে গঠিত।
এটি বিশেষভাবে দোয়া করার সময় ব্যবহৃত হয়।
🔸 এই শব্দে বিনয়ের গভীরতা এবং সরাসরি প্রভুর সাথে কথোপকথনের ভাব রয়েছে।
২. إِنِّي
🔹 অর্থ: নিশ্চয়ই আমি
🔹 মূল শব্দ: إنّ (নিশ্চয়ই) + ي (আমি)
🔹 তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ:
“ইন্নী” শব্দটি দোয়ায় নিজের দুর্বলতা ও প্রয়োজন স্বীকারের ভাষা। এতে একধরনের আত্মসমর্পণের আবেগ প্রকাশ পায়—যে আমি কিছুই না, আপনি ছাড়া আমার কোনো উপায় নেই।
৩. أَسْأَلُكَ
🔹 অর্থ: আমি আপনার কাছে চাই
🔹 মূল ধাতু: س-أ-ل (সা-আ-লা) – জিজ্ঞেস করা, চাওয়া
🔹 তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ:
“أَسْأَلُ” = আমি চাই/অনুরোধ করি
“كَ” = আপনার কাছে
🔸 এই অংশে রয়েছে আল্লাহর প্রতি সম্পূর্ণ নির্ভরতা – আমার চাওয়া শুধু আপনার কাছেই, অন্য কারো নয়।
৪. مِنْ فَضْلِكَ
🔹 অর্থ: আপনার অনুগ্রহ থেকে
🔹 মূল শব্দ:
- فَضْل (ফজল) = অতিরিক্ত দয়া, উপহার, যার জন্য আমরা যোগ্য নই
- كَ = আপনার
🔹 তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ: “ফজল” মানে এমন কিছু যা কাউকে অতিরিক্ত দেয়া হয়—যার সে আসলে প্রাপ্য নয়।
এখানে “মিন” (من) দ্বারা বোঝানো হয়েছে: হে আল্লাহ! আমি আপনার অফুরন্ত ভাণ্ডার থেকে অল্প কিছু চাই, যা আপনি দয়া করে দিতে পারেন।

🌿 এই দোয়ার প্রেক্ষাপট ও হাদিস
নবী করীম ﷺ আমাদের এমন সব সংক্ষিপ্ত অথচ অর্থবহ দোয়া শিখিয়েছেন, যেগুলো জীবনের নানা পরিস্থিতিতে কাজে আসে। এই দোয়াটি এমনই এক পরিস্থিতিতে শেখানো হয়েছে—যখন কেউ বাজারে প্রবেশ করে।
✅ আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:
যখন কেউ বাজারে প্রবেশ করে তখন সে যদি বলে:
اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ مِنْ فَضْلِكَ
(হে আল্লাহ, আমি আপনার অনুগ্রহ চাই) 📚 মুসনাদ আহমদ: ৮৮৭৮, সহীহ হাদীস
🔍 আরও কিছু বর্ণনায় এসেছে, দোয়া দীর্ঘরূপে বলা হয়েছে। যেমন:
اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ مِنْ فَضْلِكَ العَظِيمِ
“হে আল্লাহ! আমি আপনার মহা অনুগ্রহ চাই।”
আরো পড়ুন:
- আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা ইলমান নাফিয়ান
- আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা আফিয়া।
- আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকাল জান্নাহ
🌸 দোয়ার তাৎপর্য ও দর্শন
✅ ১. আল্লাহর ফজল চাওয়া মানেই তাঁর দরজায় দীনতা প্রকাশ করা
ফজল অর্থ কেবল রিজিক নয়, বরং সমস্ত কল্যাণ, উপকারিতা, শান্তি, সাফল্য, রহমত ও হিদায়াত—সবই আল্লাহর ফজলের অংশ। আল্লাহ বলেন:
قُلْ إِنَّ الْفَضْلَ بِيَدِ اللَّهِ
“বলুন: নিশ্চয়ই অনুগ্রহ একমাত্র আল্লাহর হাতেই।” 📖 সূরা আলে ইমরান: ৭৩
✅ ২. বাজারের মতো ‘মোহময়’ জায়গায় আল্লাহকে মনে করা এক প্রকার ইবাদত
বাজার হলো এমন একটি জায়গা, যেখানে দুনিয়ার মোহ, প্রতারণা ও ব্যস্ততা বেশি থাকে। এ অবস্থায় কেউ যদি আল্লাহর কথা স্মরণ করে এবং দোয়া করে, সেটা তার তাকওয়ার প্রমাণ এবং আল্লাহর বিশেষ দৃষ্টিতে পড়ার একটি উপায়।
✅ ৩. এ দোয়া শুধু বাজারে নয়—রিজিকের প্রয়োজন, চাকরি খোঁজা, দরিদ্রতা, কোনো ফর্ম ফিলআপ, পরীক্ষার আগে বা জীবনযুদ্ধে নেমে পড়ার সময়েও বলা যায়।
🌟 ফজিলত ও উপকারিতা
- 💠 আল্লাহর ফজল কখনোই সীমাবদ্ধ নয়; এ দোয়ার মাধ্যমে আমরা সব রকম কল্যাণ চাইতে পারি।
- 💠 এটি বলে বাজারে প্রবেশ করলে অনেক হাদীসে ফজিলতের কথা এসেছে। যেমন—
যে ব্যক্তি বাজারে প্রবেশ করে বলে:
لَا إِلٰهَ إِلَّا اللهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ، لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ، يُحْيِي وَيُمِيتُ، وَهُوَ حَيٌّ لَا يَمُوتُ، بِيَدِهِ الْخَيْرُ، وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ
আল্লাহ তাকে দশ লক্ষ নেকি দেন, দশ লক্ষ গুনাহ মাফ করেন এবং জান্নাতে তার জন্য একটি ঘর নির্মাণ করেন।
📚 তিরমিজি: ৩৪২৮, হাদিস সহীহ
🔸 অর্থাৎ বাজারে প্রবেশের সময় বিভিন্ন দোয়ার ফজিলত রয়েছে—তন্মধ্যে ফজল চাওয়ার দোয়াও অন্যতম।
🧠 বাস্তব জীবনে প্রয়োগ
🟩 কখন বলবো এই দোয়া?
- ✅ বাজার বা শপিংমলে প্রবেশের সময়
- ✅ চাকরি খুঁজতে গেলে
- ✅ ব্যবসা শুরু করতে গেলে
- ✅ রিজিকের সংকটে পড়লে
- ✅ কোনো প্রয়োজনে দ্বারে দ্বারে ঘোরার আগে
- ✅ অর্থকষ্ট, দুশ্চিন্তা বা অপারগতার সময়
🟩 কীভাবে অন্তর দিয়ে বলবো?
“হে আল্লাহ! আমি কিছুই নিজের জন্য করতে পারি না—আপনার অনুগ্রহই আমার একমাত্র আশা। আপনি যা দিবেন, তাই টিকবে। যা বঞ্চিত করবেন, তা আমি কখনো পাবো না।”
আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা মিন ফাদলিকা এর ফজিলত
✅ ১. আল্লাহর কাছ থেকে সরাসরি ফজল চাওয়ার মর্যাদা
এই দোয়া আল্লাহর কাছে সরাসরি তাঁর “ফজল” বা অনুগ্রহ চাওয়ার একটি ভাষা। কুরআনে বহুবার “ফজল” চাওয়ার তাগিদ এসেছে। যেমন:
فَابْتَغُوا عِندَ اللَّهِ الرِّزْقَ
“তোমরা আল্লাহর কাছেই রিজিক তালাশ করো।” 📖 সূরা আনকাবুত: ১৭
🔹 অতএব, এ দোয়া পড়া মানে আল্লাহর দরজায় রিজিক, রহমত ও কল্যাণের জন্য বিনয়ী আবেদন।
✅ ২. নবী ﷺ নিজে এই দোয়া করেছেন — এটি সুন্নাহ
✅ হজরত আবদুল্লাহ ইবনু উমর (রা.) থেকে বর্ণিত:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলতেন,
اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ مِنْ فَضْلِكَ وَرَحْمَتِكَ، فَإِنَّهُ لَا يَمْلِكُهَا إِلَّا أَنْتَ
“হে আল্লাহ, আমি আপনার ফজল ও রহমত চাই। নিশ্চয়ই একমাত্র আপনিই এগুলোর মালিক।” 📚 সুনান ইবনু মাজাহ: ৩৮৫৮ | হাদীসটি হাসান
🔍 এ হাদীস প্রমাণ করে যে, এ দোয়া ব্যক্তিগত জীবনের চাওয়ায়ও প্রযোজ্য — শুধু বাজারে নয়।
✅ ৩. বাজারে এই দোয়া পড়লে আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ বর্ষিত হয়
✅ আবু হুরাইরা (রা.) বলেন:
“যে ব্যক্তি বাজারে প্রবেশ করে এই দোয়া পড়বে:
اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ مِنْ فَضْلِكَ
হে আল্লাহ, আমি আপনার ফজল ও রহমত চাই 📚 মুসনাদ আহমদ: ৮৮৭৮ | হাদীসটি সহীহ ইসনাদে বর্ণিত
🔸 এ হাদীসের অর্থ– বাজারের মতো দুনিয়ামুখী স্থানে যদি কেউ আল্লাহকে মনে করে ও এই সংক্ষিপ্ত দোয়া করে, তবে আল্লাহ তাকে এমন অনুগ্রহ দান করেন যা সে নিজেও কল্পনা করতে পারে না।
✅ ৪. আল্লাহর ফজল চাইলে দরজা খুলে যায়
কুরআনে আল্লাহ বলেন:
وَلَوْ أَنَّهُمْ رَضُوا مَا آتَاهُمُ اللَّهُ وَرَسُولُهُ وَقَالُوا: حَسْبُنَا اللَّهُ سَيُؤْتِينَا اللَّهُ مِنْ فَضْلِهِ وَرَسُولُهُ
“তারা যদি বলত: ‘আমাদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট, তিনি আমাদের নিজ ফজল থেকে দেবেন’, তাহলে তা উত্তম হতো।” 📖 সূরা আত-তাওবা: ৫৯
🔹 ফজল চাওয়া মানেই হলো আল্লাহর দেওয়া রিজিক, সাফল্য, কল্যাণ, ইজ্জত, শান্তি — সব কিছুর জন্য তাঁর ওপর ভরসা করা।
✅ ৫. ফজল চাওয়া মানে অহংকার থেকে মুক্ত থাকা
এই দোয়া আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, আমরা নিজের যোগ্যতায় নয়—বরং আল্লাহর দয়ায় বাঁচি, চলি, সফল হই। এটা বিনয়ের চূড়ান্ত রূপ।
🔚 সংক্ষেপে ফজিলতের সারসংক্ষেপ:
বিষয় | ফজিলত |
---|---|
📿 দোয়ার সূত্র | সহীহ হাদীসে প্রমাণিত |
🌈 ফলাফল | আল্লাহর ফজল ও রহমত লাভ |
🏞 প্রেক্ষাপট | বাজারে প্রবেশ, রিজিকের প্রয়োজনে, যেকোনো কল্যাণের কামনায় |
💡 তাৎপর্য | আত্মসমর্পণ, আল্লাহর ওপর নির্ভরতা ও দুনিয়াবিমুখতা |
🌿 ফজল (فضل) আর নিয়ামত (نعمة) – পার্থক্য ও গভীরতা
🔹 ১. অর্থগত পার্থক্য
শব্দ | আভিধানিক অর্থ | ব্যাখ্যা |
---|---|---|
ফজল (فضل) | অতিরিক্ত দয়া, অনুগ্রহ, উপহার | যা প্রাপকের প্রাপ্য নয়, তবুও আল্লাহ দয়া করে দেন |
নিয়ামত (نعمة) | নিয়ামত, সুখ, কল্যাণ, অনুকম্পা | যা জীবনে উপকার বয়ে আনে, প্রাপকের উপকারে আসে |
🔹 ২. কুরআনিক দৃষ্টিকোণ
📖 ফজল
“قُلْ إِنَّ الْفَضْلَ بِيَدِ اللَّهِ يُؤْتِيهِ مَن يَشَاءُ”
বলুন, নিশ্চয়ই অনুগ্রহ আল্লাহরই হাতে। তিনি যাকে ইচ্ছা তা দেন। (সূরা আলে ইমরান, ৩:৭৩)
✅ এখানে বোঝা যাচ্ছে, ফজল হল এমন কিছু যা আল্লাহ নিজের ইচ্ছায় কাউকে দেন, সেটার জন্য আপনি চেষ্টা করলেও অনেকে পায় না, আর চেষ্টা ছাড়াও কেউ কেউ পায়।
📖 নিয়ামত
“وَإِن تَعُدُّوا نِعْمَةَ اللَّهِ لَا تُحْصُوهَا”
তোমরা যদি আল্লাহর নিয়ামত গণনা করতে চাও, গণনা করে শেষ করতে পারবে না। (সূরা ইবরাহিম, ১৪:৩৪)
✅ নিয়ামত হলো জীবনের প্রতিটি সুবিধা, উপকার, সুবিধাজনক অবস্থা – যা আল্লাহ আমাদের দিয়েছেন, ছোট হোক বা বড়।
🔚 উপসংহার
“اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ مِنْ فَضْلِكَ” — এই ছোট্ট দোয়ার মাঝে লুকিয়ে আছে এক বিশাল মানসিক প্রশান্তি ও আত্মিক আত্মসমর্পণ। আল্লাহর কাছে ফজল চাওয়ার অর্থই হলো, আমরা নিজেকে নির্ভরশীল বানিয়ে দিচ্ছি সর্বশক্তিমান, সর্বদাতা, পরম দয়ালু রবের ওপর। যে মানুষ প্রতিদিন অন্তর থেকে আল্লাহর ফজল চায়, তার জীবনে অভাব থাকতে পারে—কিন্তু হতাশা থাকবে না।