মানুষের জীবনে সবচেয়ে বড় ভয়গুলোর একটি হলো দারিদ্র্য, অক্ষমতা এবং অপমান। এই তিনটি জিনিস কেবল বাহ্যিক জীবনকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে না, বরং ধীরে ধীরে মনের ভিতরেও এক অজানা অন্ধকার নামিয়ে আনে। আর ঠিক সেই কারণেই প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আল্লাহর কাছে বারবার এই তিনটি জিনিস থেকে আশ্রয় চাইতেন। তিনি বলতেন, আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিনাল ফাকরি ওয়াল কিল্লাতি ওয়াজজিল্লাতি –
“اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْفَقْرِ وَالْقِلَّةِ وَالذِّلَّةِ”
— কেবল একটি আরবিক বাক্য নয়, বরং এটি একটি জীবনের শিক্ষা। একটি আত্মমর্যাদার প্রার্থনা। একটি সম্মান ও প্রাচুর্যের আকুতি।
এই লেখায় আমরা এই দোয়ার শব্দগুলোর অর্থ, হাদীসের উৎস, এর অন্তর্নিহিত শিক্ষা ও আমাদের বাস্তব জীবনে এর প্রয়োগ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব — যেন আমরা আল্লাহর এই পবিত্র দোয়াকে হৃদয়ে ধারণ করে জীবনকে আরও আলোকিত করতে পারি।
🕋 দোয়ার পূর্ণ রূপ ও উচ্চারণ
📜 আরবি দোয়া:
اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْفَقْرِ وَالْقِلَّةِ وَالذِّلَّةِ
🗣️ বাংলা উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা ইন্নি আঊযু বিকা মিনাল ফাকরি ওয়াল কিল্লাতি ওয়ায্-জিল্লাতি
🌾 বাংলা অর্থ: হে আল্লাহ, আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাই দারিদ্র্য থেকে, স্বল্পতা থেকে এবং অপমান থেকে।

✨ ২. দোয়ার উৎস: হাদীস থেকে উল্লেখ
📚 সহীহ হাদীস থেকে এই দোয়ার প্রমাণ
এই দোয়াটি প্রিয় নবী মুহাম্মদ ﷺ বিভিন্ন দোয়াগুলোর মধ্যে একাধিকবার উল্লেখ করেছেন, এবং সাহাবীরা তা সংরক্ষণ করেছেন। নিচের হাদীসে এই দোয়ার নির্ভরযোগ্য রেফারেন্স পাওয়া যায়।
👤 বর্ণনাকারীর নাম
আবূ হুরায়রা (রাদিয়াল্লাহু আনহু), 📖 হাদীসের উৎস
মুসনাদ আহমাদ : হাদীস নম্বর: ৮১৯৫, রেওয়ায়েতের মান: সহীহ (ইমাম আহমাদ, হাকেম, এবং অন্যান্য মুহাদ্দিসগণ সহীহ বলেছেন)
🕋 হাদীসের মূল আরবি
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، أَنَّهُ كَانَ يَدْعُو: اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْفَقْرِ، وَالْقِلَّةِ، وَالذِّلَّةِ، وَأَعُوذُ بِكَ مِنْ أَنْ أَظْلِمَ، أَوْ أُظْلَمَ
🌿 হাদীসের বাংলা অনুবাদ
আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি (নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এই দোয়া করতেন: “হে আল্লাহ, আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাই দারিদ্র্য থেকে, স্বল্পতা থেকে, অপমান থেকে, এবং আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাই যেন আমি জুলুম না করি এবং কেউ যেন আমার উপর জুলুম না করে।”
🧠 ৩. দোয়ার শব্দভিত্তিক বিশ্লেষণ
الفقر (আল-ফাকর) – দারিদ্র্য
শাব্দিক অর্থ: “ফাকর” (الفقر) শব্দটি মূল আরবি “ف-ق-ر” ধাতু থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ ভাঙা, ফেটে যাওয়া বা ঘাটতি সৃষ্টি হওয়া।
প্রাসঙ্গিকতা: ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে দারিদ্র্য কেবল অর্থনৈতিক দুরবস্থাই নয়; বরং এটি এমন একটি অবস্থা, যেখানে মানুষ তার প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয় এবং অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে পড়ে।
রাসূল ﷺ দারিদ্র্য থেকে আল্লাহর আশ্রয় চেয়েছেন, কারণ দারিদ্র্য অনেক সময় কুফর ও অপমানের পথে ধাবিত করে।
القلة (আল-কিল্লাহ) – স্বল্পতা / সামর্থ্যের অভাব
শাব্দিক অর্থ: “কিল্লাহ” (القلة) এসেছে “ق-ل-ل” মূল ধাতু থেকে, যার অর্থ হলো কম হওয়া বা অপ্রতুলতা।
প্রাসঙ্গিকতা: এটি শুধু অর্থ নয়, বরং সময়, জ্ঞান, ধৈর্য, ঈমান, সাহায্যকারী বা রিজিক — সব কিছুর কমতি বুঝাতে পারে।
রাসূল ﷺ এই দোয়ায় “স্বল্পতা” থেকে আল্লাহর আশ্রয় চেয়েছেন, যাতে জীবনের প্রয়োজনীয় দিকগুলোতে অক্ষমতা না আসে।
الذلة (আয-যিল্লাহ) – অপমান / লাঞ্ছনা
শাব্দিক অর্থ: “যিল্লাহ” (الذلة) এসেছে “ذ-ل-ل” ধাতু থেকে, যার অর্থ নিচু হওয়া, নত হওয়া বা অপমানিত অবস্থায় পড়া।
প্রাসঙ্গিকতা: মানবজীবনে অপমান সবচেয়ে যন্ত্রণাদায়ক এক অবস্থা। এটি কেবল বাহ্যিক নয়; বরং আত্মসম্মান, মনের শান্তি এবং সামাজিক অবস্থানের উপর গভীর প্রভাব ফেলে।
নবীজি ﷺ আল্লাহর কাছে আশ্রয় চেয়েছেন যেন তিনি অপমানের মুখোমুখি না হন — কারণ একজন মুমিনের জীবন হবে মর্যাদাপূর্ণ, নতজানু নয়।
এই তিনটি শব্দ একত্রে আমাদের শেখায় — 👉 কেবল দারিদ্র্য নয়, দারিদ্র্যের পরিণতি (অক্ষমতা ও অপমান) থেকেও আল্লাহর সাহায্য চাইতে হয়। এটি একপ্রকার সমগ্র জীবনের নিরাপত্তার দোয়া।
🕋 ৪. কেন রাসূল (ﷺ) এই দোয়াটি করতেন?
প্রিয়নবি মুহাম্মদ ﷺ ছিলেন আল্লাহর সবচেয়ে প্রিয় বান্দা, যিনি দুনিয়ার সকল কষ্ট ও অপমান ধৈর্যের সঙ্গে সহ্য করেছেন। তারপরও তিনি বারবার এই দোয়া করতেন:
“হে আল্লাহ, আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাই দারিদ্র্য, স্বল্পতা এবং অপমান থেকে।” এটি আমাদের জন্য একটি মহামূল্যবান বার্তা বহন করে।
📉 ইসলামে দারিদ্র্য ও অপমানের কুফল
দারিদ্র্য (الفقر) এমন একটি পরীক্ষা যা অনেক সময় মানুষকে পাপের পথে নিয়ে যেতে পারে। নবীজি ﷺ বলেছেন:
“দারিদ্র্য প্রায়ই মানুষকে কুফরীর দিকে ঠেলে দেয়।” (সহীহ বুখারী, তাফসির অধ্যায়)
একজন দরিদ্র ব্যক্তি অভাবের চাপে পাপ করতে পারে — চুরি, সুদ, মিথ্যা, আত্মসমর্পণ ইত্যাদি। তাই দারিদ্র্য নিজেই একটি দুশ্চিন্তা নয়, বরং তার পরিণতিগুলো ভয়ংকর হতে পারে। এ কারণেই নবীজি ﷺ এ থেকে আশ্রয় চাইতেন।
💎 আত্মমর্যাদা ও রিজিকের গুরুত্ব
ইসলাম একজন মুমিনকে আত্মমর্যাদার সঙ্গে জীবন যাপন করতে শিক্ষা দেয়। এক মুমিন আল্লাহর উপর ভরসা করে সম্মানের পথে জীবন চালায়, চাটুকারিতা করে বা নিচু হয়ে জীবন পার করে না।
কুরআনে আল্লাহ বলেন:
“আর সম্মান তো কেবল আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও মুমিনদের জন্য।” (সূরা মুনাফিকুন ৬৩:৮)
রিজিকের প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন:
“তিনিই রিজিক দানকারী, কঠিন শক্তির মালিক।” (সূরা আয্-যারিয়াত ৫১:৫৮)
অর্থাৎ, সম্মান ও রিজিক উভয়ই আল্লাহর নিয়ন্ত্রণে। তাই নবীজি ﷺ এই দুই বিষয়ের ঘাটতি ও অপমান থেকে আল্লাহর আশ্রয় চাইতেন।
🧍♂️ সমাজে সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার গুরুত্ব
সম্মানহীন জীবন মানেই এক প্রকার মৃত জীবন। একজন মুসলিম যেমন হীনমন্য হয়ে জীবন যাপন করে না, তেমনি অহংকারও করে না। ইসলাম মধ্যপন্থা শিখিয়েছে — যেখানে সম্মান হয় ঈমান, চরিত্র ও সচ্চরিত্রতার মাধ্যমে।
নবীজি ﷺ অপমান থেকে আশ্রয় চেয়ে আমাদের শিখিয়েছেন যে, সমাজে নিজ মর্যাদা রক্ষা করা ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। কারণ একজন অপমানিত ব্যক্তি সহজেই হতাশ হয়ে পড়ে এবং সমাজে তার প্রভাব কমে যায়।
🌍 ৬. বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে এই দোয়ার গুরুত্ব
যুগ পাল্টেছে, প্রযুক্তি এগিয়েছে, কিন্তু মানুষের অন্তরের চাহিদা ও নিরাপত্তাহীনতা এখনো অম্লান। আজকের এই অস্থির, অনিশ্চিত এবং প্রতিযোগিতাপূর্ণ বিশ্বে
اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْفَقْرِ وَالْقِلَّةِ وَالذِّلَّةِ
আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিনাল ফাকরি ওয়াল কিল্লাতি ওয়াজজিল্লাতি
এই দোয়ার আবেদন আগের যেকোনো সময়ের চেয়েও বেশি।
💸 অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ও মানসিক চাপ
- বর্তমান বিশ্ব অর্থনীতি প্রতিনিয়ত ওঠানামা করছে।
- চাকরি হারানো, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, ঋণের বোঝা, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ — এসব মানুষের মানসিক ভারসাম্য ও আস্থা নষ্ট করে দিচ্ছে।
- এই দোয়ায় “الفقر” ও “القلة” থেকে আশ্রয় চেয়ে আমরা আল্লাহর কাছে চাচ্ছি এমন এক অবস্থার মুক্তি, যেখানে আমাদের প্রয়োজন পূরণ হবে মর্যাদার সঙ্গে, হতাশা ও অবসাদ ছাড়াই।
📌 মানসিক সুস্থতার একটি বড় চাবিকাঠি হলো অর্থনৈতিক স্থিতি — আর সেই স্থিতির জন্যই এ দোয়া আমাদের রূহানী হাতিয়ার।
🧨 সামাজিক অপমানের আধুনিক রূপ
- আজ অপমান কেবল সামনাসামনি নয় — সোশ্যাল মিডিয়া, অনলাইন বুলিং, অপপ্রচার, মানহানিকর মন্তব্যে তা অনেক বেশি বেড়ে গেছে।
- পারিবারিক, কর্মক্ষেত্র বা কমিউনিটিতে সম্মান হারানো অনেক সময় মানুষকে চরম হতাশা, বিষণ্নতা ও আত্মহত্যার পথে ঠেলে দেয়।
- “الذلة” শব্দটি এমন একটি অবস্থা নির্দেশ করে, যেখানে মানুষ নিজেকে একেবারে তুচ্ছ ও পরাজিত মনে করে।
📌 এই দোয়া সেই পরিস্থিতি থেকে আত্মাকে আগলে রাখার এক পর্দা — যেখানে সম্মান কেবল মানুষের হাতে নয়, বরং আল্লাহর হেফাজতে।
🧕 আত্মসম্মান ও ইসলামিক চেতনা
- আধুনিক সমাজ অনেক সময় মুসলিমদেরকে অপমানের চোখে দেখে — ইসলামফোবিয়া, নাস্তিকতা, কটাক্ষ ইত্যাদির মাধ্যমে।
- একজন মুসলিমের পরিচয়, হিজাব, দাঁড়ি, বা নাম আজ অনেক জায়গায় উপহাসের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
- এই দোয়া আমাদের আত্মমর্যাদা বজায় রাখতে সাহায্য করে — যেন আমরা মাথা উঁচু করে বলি:
“আমরা মুসলিম, আমাদের সম্মান আল্লাহর কাছ থেকেই আসে।”
📌 দুনিয়ার অপমান নয়, আমরা চাহি আল্লাহর কাছে সম্মান ও রক্ষা — আর এই দোয়াই তা চায়।
🛤️ ৭. আমাদের জীবনে এই দোয়া কীভাবে যুক্ত করবো?
আল্লাহর নিকট প্রার্থনা শুধু একটি ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা নয় — বরং তা একজন মুমিনের হৃদয়ের সবচেয়ে বড় আশ্রয় ও শান্তির জায়গা। তাই “اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْفَقْرِ وَالْقِلَّةِ وَالذِّلَّةِ” — আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিনাল ফাকরি ওয়াল কিল্লাতি ওয়াজজিল্লাতি, এই দোয়াটি আমরা যদি নিজের জীবনের অংশে পরিণত করি, তাহলে আমাদের মানসিক, সামাজিক ও রূহানী জীবন আরও দৃঢ় ও ভারসাম্যপূর্ণ হয়ে উঠবে।
📿 ১. দৈনন্দিন দোয়ার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা
- এই দোয়াটি আপনি নিজের প্রাত্যহিক দোয়া বা যিকিরের তালিকায় রাখুন।
- সকালে ঘুম থেকে উঠে এবং রাতে ঘুমানোর আগে এই দোয়া পাঠ করা এক অনন্য অভ্যাসে পরিণত হতে পারে।
- চাইলে একটি ছোট্ট কার্ডে লিখে রাখুন, মোবাইলে ওয়ালপেপার বানান অথবা ডেস্কে লাগিয়ে রাখুন।
📌 নিয়মিত পাঠ আপনাকে মনে করিয়ে দেবে — আপনি কেবল রুটি-রুজির জন্য নয়, আত্মমর্যাদা ও রূহানী শক্তির জন্যও আল্লাহর দরজায় কাতর।
🙏 ২. নামাজের পর পড়া
- পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পর এ দোয়াটি একবার হলেও পাঠ করুন।
- বিশেষ করে ফজর ও মাগরিবের পর, যখন মন কিছুটা স্থির থাকে, তখন এই দোয়া হৃদয় দিয়ে পড়লে গভীর প্রভাব ফেলে।
- ইমামতিতে থাকা ব্যক্তিরাও চাইলে নামাজ শেষে এই দোয়ার শিক্ষা দিতে পারেন মুসুল্লিদের।
📌 নামাজের পর দোয়া করা হৃদয়ের জন্য উর্বর সময় — এই দোয়ার মাধ্যমে নিজের ভবিষ্যৎকে আল্লাহর হাতে তুলে দিন।
🕳 ৩. সংকটময় সময়ে আল্লাহর উপর নির্ভরতা
- যখন অর্থনৈতিক সংকট, সামাজিক অপমান, আত্মবিশ্বাস হারানো কিংবা পারিবারিক সমস্যায় পড়বেন — তখন এই দোয়া বিশেষভাবে পড়ুন।
- নিজেকে বুঝান: “আমি মানুষের কাছে নয়, আল্লাহর কাছেই রিজিক, মর্যাদা ও নিরাপত্তা চাই।”
- এই দোয়া কেবল জিহ্বায় নয়, হৃদয়ে অনুভব করুন।
📌 সংকটে ভেঙে পড়া নয় — সংকটে আল্লাহর কাছে ছুটে যাওয়াই একজন প্রকৃত মুমিনের পরিচয়।
✅ কীভাবে শুরু করবেন?
- দৈনিক একবার করে নিয়মিত পাঠ করুন।
- বাংলা অর্থ ভালোভাবে মুখস্থ করে দোয়াটি উপলব্ধি করার চেষ্টা করুন।
- পরিবারের সদস্যদেরও এই দোয়া শিখান, বিশেষ করে শিশুদের।
🏞️ ৮. সাহাবীদের দৃষ্টিতে দারিদ্র্য ও সম্মান
সাহাবায়ে কেরাম ছিলেন এমন এক প্রজন্ম, যাঁদের জীবনে দ্বীনের শিক্ষা ও বাস্তব জীবন হাতে-কলমে একাকার ছিল। দারিদ্র্য, অপমান ও আত্মমর্যাদার প্রশ্নে তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের জন্য আজও পথনির্দেশক।
🧔🏻 হযরত উমর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) – আত্মমর্যাদার প্রতীক
হযরত উমর (রাঃ) ছিলেন খলিফার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েও পরিশ্রম করে জীবিকা অর্জনের পক্ষপাতী। তাঁর বিখ্যাত উক্তি:
“আমি এমন লোককে অপছন্দ করি, যে জীবিকা ছাড়া বসে থাকে এবং বলে, ‘আল্লাহ আমাকে রিজিক দেবেন।’ অথচ সে কাজ করে না।” (মুয়াত্তা মালিক)
🔹 এই কথার মাধ্যমে তিনি শিখিয়েছেন –
👉 দারিদ্র্যকে ভাগ্য নয়, বরং কর্ম ও দ্বীনের সঙ্গে সমন্বয় করে কাটিয়ে উঠতে হবে।
তিনি আরও বলতেন:
“আমরা এমন এক জাতি, যাদের সম্মান আল্লাহ দিয়েছেন ইসলাম দ্বারা। আমরা যদি ইসলাম ছাড়া অন্য কিছুর মধ্যে সম্মান খুঁজি, আল্লাহ আমাদের অপমানিত করবেন।” (আল-হায়তুল উমার)
🔹 এখানেই স্পষ্ট হয় যে, সম্মান খোঁজার পথ শুধুই ইসলাম — অন্য কিছু নয়।
🧕 অন্যান্য সাহাবীদের দৃষ্টিভঙ্গি
- হযরত আবূ উবাইদা (রাঃ): একবার তাঁকে ধন-সম্পদ দেওয়া হলে তিনি তা গরীবদের মাঝে বিলিয়ে দেন, এবং বলেন, “ধন-সম্পদ আত্মাকে ভারী করে, আমি তা হালকা করে দিতে চাই।”
- হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রাঃ): ছিলেন ধনী ব্যবসায়ী। কিন্তু কখনো দারিদ্র্যকে ভয় পাননি; বরং দান ও সাদাকার মাধ্যমে নিজেকে সম্মানিত রাখতেন।
- সাহাবীরা দারিদ্র্যকে অপমানজনক মনে করতেন না, যদি তা হালাল পথে হয়। কিন্তু তাঁরা ভিক্ষাবৃত্তি, অলসতা এবং মানুষের মুখাপেক্ষী হওয়াকে ঘৃণা করতেন।
📖 ইসলাম দারিদ্র্যকে কীভাবে দেখেছে?
১. দারিদ্র্য নিজে কোনো গুনাহ নয়।
– নবীজি ﷺ নিজেও দীর্ঘ সময় অর্থনৈতিক কষ্টে ছিলেন।
– কিন্তু তা ছিল ধৈর্য ও ইমানের পরীক্ষার জন্য।
২. তবুও দারিদ্র্য থেকে আশ্রয় চাওয়ার নির্দেশ এসেছে।
– কারণ, দারিদ্র্য মানুষকে কখনো দুর্বল করে তোলে, ঈমান নষ্ট করতে পারে।
৩. ইসলামে হালাল উপার্জনের উৎসাহ আছে।
– কুরআনে আল্লাহ বলেন:
“তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ো এবং আল্লাহর অনুগ্রহ তালাশ করো।” (সূরা জুমু‘আ, ৬২:১০)
৪. ভিক্ষাবৃত্তি নিরুৎসাহিত করা হয়েছে।
– রাসূল ﷺ বলেন:
“ভিক্ষা কেবল সেই ব্যক্তির জন্য, যে খুব দরিদ্র অথবা ঋণে জর্জরিত।” (তিরমিজি)
🧭 ১০. উপসংহার
মানবজীবনের প্রতিটি স্তরে দোয়ার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। কিন্তু কিছু দোয়া এমন থাকে, যেগুলোর আবেদন কালের সীমা ছাড়িয়ে যায় — যেমন এই দোয়া:
اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْفَقْرِ، وَالْقِلَّةِ، وَالذِّلَّةِ
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিনাল ফাকরি ওয়াল কিল্লাতি ওয়াজজিল্লাতি
“হে আল্লাহ, আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাই দারিদ্র্য, স্বল্পতা ও অপমান থেকে।”
এই দোয়া আমাদের শেখায় —
👉 রিজিকের মালিক আল্লাহ,
👉 সম্মানের উৎসও আল্লাহ,
👉 আর পরিপূর্ণ আশ্রয়ও কেবল তিনিই।
যেখানে চারপাশে অর্থনৈতিক সংকট, মানসিক চাপ, আত্মসম্মানের হুমকি এবং অপমানের ভয় বিরাজমান — সেখানে একজন মুমিনের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো দোয়ার মাধ্যমে আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলা।
📌 পরামর্শ
✅ এই দোয়াকে কেবল মুখে নয়, হৃদয়ে ধারণ করুন।
✅ প্রতিদিন অন্তত একবার পাঠ করুন — নামাজের পর, ঘুমের আগে বা দিনের শুরুর মুহূর্তে।
✅ সন্তান ও পরিবারের সদস্যদের এই দোয়া শেখান, যেন তারা আত্মমর্যাদা ও আস্থা নিয়ে বড় হতে পারে।
✅ স্মরণ রাখুন — যে ব্যক্তি আল্লাহর কাছে সম্মান চায়, সে দুনিয়া ও আখিরাতের সম্মান অর্জনের পথেই রয়েছে।
আরো পড়দে পারেন:
- আল্লাহুম্মা ইন্নি আউযুবিকা মিনাল বারসি: অর্থ, গুরুত্ব ও আমল
- আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিনাল ফাকরি । পূর্ণ দোয়া । আরিব ও বাংলা
- আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা ইলমান নাফিয়ান । আরবি । অর্থ ও ব্যাখ্যা
🤲 শেষ কথা
দোয়া একমাত্র সেই মাধ্যম, যা কখনো ব্যর্থ হয় না — যদি অন্তর হয় আন্তরিক, হৃদয় হয় বিনম্র, আর বিশ্বাস হয় পরিপূর্ণ।
আসুন, আমরা সবাই এই মহামূল্যবান দোয়াটিকে জীবনের অংশ বানিয়ে ফেলি — যেন আল্লাহ আমাদের রক্ষা করেন দারিদ্র্য, অসহায়ত্ব ও অপমানের অপশক্তি থেকে।