খতমে খাজেগান: ইসলামের দৃষ্টিতে একটি বিশদ বিশ্লেষণ

শেয়ার করুন

খতমে খাজেগান নামের একটি বিশেষ ধরণের আমল মুসলিমদের মধ্যে প্রচলিত। এটি মূলত বিভিন্ন দো’আ ও সূরা পাঠের একটি ধারাবাহিক পদ্ধতি, যা কঠিন পীড়া ও বিপদাপদ থেকে মুক্তি লাভের জন্য করা হয়। খতমে খাজেগান একটি বিতর্কিত বিষয়, কারণ এটি কুরআন ও হাদীসে সরাসরি প্রমাণিত নয় এবং এর প্রয়োগ ও ফযিলত নিয়ে ইসলামী পণ্ডিতদের মধ্যে ভিন্ন মত রয়েছে। এই ব্লগ পোস্টে আমরা খতমে খাজেগানের বিস্তারিত নিয়ম, দো’আগুলো, ইসলামের মূল উৎস কুরআন ও হাদীসের আলোকে এর গ্রহণযোগ্যতা এবং কেন কিছু ইসলামী পণ্ডিত এটিকে বিদআত মনে করেন তা নিয়ে আলোচনা করব।

খতমে খাজেগান কী?

খতমে খাজেগান হলো একটি বিশেষ প্রার্থনা বা দো’আ পদ্ধতি, যা মূলত সুফি পীরদের প্রচলিত। এটি ‘খাজা’ শব্দের বহুবচন ‘খাজেগাঁ’ থেকে উদ্ভূত। এই প্রথাটি সুফি পীরান পীরদের নামানুসারে পরিচিতি পেয়েছে। খতমে খাজেগানে নির্দিষ্ট কিছু সূরা ও দো’আ পাঠ করা হয়, যার মাধ্যমে আল্লাহর কাছে কষ্ট মোচন ও মনোবাসনা পূরণের প্রার্থনা করা হয়। এই প্রকার খতমকে বিদআত বা ধর্মে নতুন প্রবর্তন হিসাবে বিবেচনা করা হয়, কারণ ইসলামের প্রাথমিক যুগে এটি ছিলো না। এটি প্রচলিত হয়েছে সুফি পীরদের হাত ধরে।

খতমে খাজেগান পড়ার নিয়ম

খতমে খাজেগান পড়ার নিয়ম নিম্নরূপ:

১. সূরা ফাতেহা ৭০ বার।

২. দুরূদ শরীফ ১০০ বার।

৩. সূরা ‘আলাম নাশরাহ লাকা’ ৭০ বার।

৪. সূরা ইখলাস ১০০০ বার।

৫. পুনরায় সূরা ফাতেহা ৭ বার।

৬. পুনরায় দুরূদ শরীফ ১০০ বার।

৭. নিম্নক্ত দো‘আ ১০০ বার:

  • “فسهل يا الهي كل صعب بحرمة سيد الأبرار سهل بفضلك يا عزيز”
  • (হে আল্লাহ, নেক্কারগণের সরদারের (নবী সা.) সম্মানার্থে আমার প্রত্যেক কঠিন কাজ সহজ করিয়া দাও, হে ক্ষমাশীল, তোমার দয়ায় সহজ করিয়া দাও।)

৮. يا قاضي الحاجات (হে প্রয়োজন পূর্ণকারী) ১০০ বার।

  • يا كافي المهمات (হে বৃহৎ কাজ সমাধানকারী) ১০০ বার।
  • يا دافع البليات (হে বিপদ প্রতিরোধকারী) ১০০ বার।
  • يامجيب الدعوات (হে প্রার্থনা কবুলকারী) ১০০ বার।
  • يا رافع الدرجات (হে মর্যাদা বর্ধনকারী) ১০০ বার।
  • يا حلال المشكلات (হে বিপদ দূরকারী) ১০০ বার।
  • يا غوث أغثني وامددني (হে সাহায্যকারী আমায় সাহায্য ও মদদ কর) ১০০ বার।
  • انا لله وانا اليه راجعون (নিশ্চয় আমরা আল্লাহর এবং তার নিকটই আমরা ফিরে যাব) ১০০ বার।
  • لا اله الا انت سبحانك اني كنت من الظالمين (তুমি ছাড়া অন্য কোনো উপাস্য নেই। তুমি পবিত্র। নিশ্চয় আমি গোনাহ্গার) ১০০ বার।

৯. সর্বশেষ দুরূদ একশত বার।

খতমে খাজেগান এর দোয়াগুলো

আরবি ও বাংলা অর্থ

১. সূরা ফাতেহা:

  • আরবি: بسم الله الرحمن الرحيم الحمد لله رب العالمين
  • বাংলা: পরম করুণাময় আল্লাহর নামে শুরু করছি। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি বিশ্বজগতের পালনকর্তা।

২. দুরূদ শরীফ:

  • আরবি: اللهم صل على محمد وعلى آل محمد
  • বাংলা: হে আল্লাহ, মুহাম্মদ (সা.) এবং তাঁর পরিবারে রহমত বর্ষণ কর।

৩. সূরা আলাম নাশরাহ:

  • আরবি: الم نشرح لك صدرك
  • বাংলা: আমি কি আপনার বক্ষ প্রশস্ত করি নি?

৪. সূরা ইখলাস:

  • আরবি: قل هو الله أحد
  • বাংলা: বল, তিনি আল্লাহ, এক।

বিশেষ দো‘আ

  • “فسهل يا الهي كل صعب بحرمة سيد الأبرار سهل بفضلك يا عزيز”
    • বাংলা: হে আল্লাহ নেক্কারগণের সরদারের (নবী সা.) সম্মানার্থে আমার প্রত্যেক কঠিন কাজ সহজ করিয়া দাও, হে ক্ষমাশীল, তোমার দয়ায় সহজ করিয়া দাও।

    কুরআন ও হাদীসের রেফারেন্স

    খতমে খাজেগান আমলটি সরাসরি কুরআন বা হাদীস থেকে প্রমাণিত নয়। যদিও এতে ব্যবহৃত দো’আ এবং সূরাগুলো কুরআন ও হাদীস থেকে নেয়া হয়েছে, তবুও এ ধরণের নির্দিষ্ট নিয়ম ও ফযিলত কুরআন ও হাদীসে পাওয়া যায় না। ইসলামে আমলের ক্ষেত্রে তাওক্বীফি (ওহি নির্ভর) হওয়ার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ কোনো আমল বা ইবাদত শুধুমাত্র তখনই বৈধ ও ফজিলতপূর্ণ যখন তা কুরআন ও হাদীসে প্রমাণিত হয়।

    খতমে খাজেগান এর উপকার

    খতমে খাজেগান কোনো ‍উপকার নেই। বস্তুত অনেক মুসলিম বিশ্বাস করেন যে, খতমে খাজেগান পড়ে তারা বিভিন্ন কঠিন পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেয়েছেন এবং তাদের মনোকামনা পূর্ণ হয়েছে। কিন্তু প্রকৃত সত্য হল এটি একটি বিদআত বা গোনাহের কাজ। এর বদলে সুন্নাহ সম্মত আমল বিশেষ করে যারা দোয়া যিকর করলে মানসিক শান্তি ও তৃপ্তি লাভ কার যাবে।

    খতমে খাজেগান পড়া বিদআত কেন?

    খতমে খাজেগান পড়া বিদআত, কারণ এটি কুরআন ও হাদীসে সরাসরি প্রমাণিত নয় এবং ইসলামের মূল উৎস থেকে এটি অনুমোদিত নয়। ইসলামের বিধানে নতুন কোনো আমল বা ইবাদত প্রবর্তন করা বিদআত হিসেবে গণ্য হয়।

    আবু হানিফা রাহ. এর মতামত

    ইমাম আবু হানিফা এবং তার দুই বিশিষ্ট ছাত্র ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মদ রাহ. এর মত অনুযায়ী, কোনো আমল বা দো’আ শুধুমাত্র আল্লাহর নাম, গুণ ও সত্তার মাধ্যমে করা উচিত। অন্য কোনো মাধ্যম বা মর্যাদার দোহাই দিয়ে দো’আ করা মাকরূহ।

    সালাফে সালিহিনের অনুসরণ

    সালাফে সালিহিন থেকে এ কথা স্বীকৃত যে, আল্লাহর কাছে কিছু চাইতে কোনো ব্যক্তি মিডিয়া বা ব্যক্তির মর্যাদাকে মিডিয়া বানানোর প্রয়োজন নেই। আল্লাহর বিধান রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিখানো পদ্ধতিতে পালনের মাধ্যমে সফলতা লাভ করা যায়।

    খতমে খাজেগানের বিকল্প

    ইসলামে, প্রার্থনা ও দো’আর অনেক সুন্নাহ এবং হাদীসে প্রমাণিত পদ্ধতি রয়েছে, যা খতমে খাজেগানের বিকল্প হিসাবে পালন করা যেতে পারে। এই পদ্ধতিগুলো সরাসরি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শেখানো ও অনুসৃত, তাই এগুলো বিদআত থেকে মুক্ত এবং আল্লাহর নিকট প্রিয়।

    ১. কুরআন তিলাওয়াত

    কুরআন তিলাওয়াত বা পাঠ করা ইসলাম ধর্মে একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল। এটি আল্লাহর বাণী এবং এর প্রতিটি আয়াতের রয়েছে আলাদা ফজিলত। সূরা ফাতিহা, সূরা ইখলাস, সূরা ফালাক, সূরা নাস এবং সূরা বাকারা নিয়মিত তিলাওয়াত করা উচিত।

    ২. নফল নামাজ

    নফল নামাজ ইসলামের একটি বিশেষ আমল যা সুন্নাহ ও নফল ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত। তাহাজ্জুদ, ইশরাক এবং দুহা নামাজ হচ্ছে কিছু উল্লেখযোগ্য নফল নামাজ। এগুলি নিয়মিত পড়া মানসিক প্রশান্তি এবং আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য খুবই উপকারী।

    ৩. নিয়মিত যিকর ও আসকার

    নিয়মিত যিকর আল্লাহকে স্মরণ করার একটি উত্তম পদ্ধতি। কিছু গুরুত্বপূর্ণ যিকর হচ্ছে:

    • সুবহানাল্লাহ (আল্লাহ মহান)
    • আলহামদুলিল্লাহ (সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য)
    • আল্লাহু আকবর (আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ)
    • লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ (আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই)

    ৪. ইস্তিগফার

    ইস্তিগফার, বা আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা, ইসলামের একটি মৌলিক প্রথা। এটি আল্লাহর নিকট সকল পাপ থেকে মুক্তি ও মাফ পাওয়ার জন্য অন্যতম উপায়।

    ৫. দরূদ শরীফ

    দরূদ শরীফ, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি দো’আ ও সালাম প্রেরণ, কষ্ট লাঘব ও শান্তি প্রার্থনার জন্য অত্যন্ত ফযিলতপূর্ণ। এটি নিয়মিত পাঠ করা আল্লাহর নৈকট্য লাভের অন্যতম মাধ্যম।

    ৬. সূরা আল-ইখলাস, আল-ফালাক এবং আন-নাস

    এই তিনটি সূরা রোগ-বালাই, কষ্ট ও বিপদ থেকে রক্ষা পেতে নিয়মিত পাঠ করা হয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই সূরাগুলো নিয়মিত পড়ার উপদেশ দিয়েছেন।

    ৭. দো’আ কুনূত

    দো’আ কুনূত, যা বিতর নামাযের সময় পাঠ করা হয়, আল্লাহর নিকট দো’আ করার অন্যতম সুন্নাহ পদ্ধতি। এটি বিপদ ও সংকট থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য পাঠ করা যায়।

    ৮. হাদীসে প্রমাণিত অন্যান্য দো’আ

    নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের অনেক দো’আ শিখিয়েছেন, যা বিভিন্ন সময়, পরিস্থিতি ও উদ্দেশ্যে পাঠ করা হয়। এই দো’আগুলো আল্লাহর নিকট সরাসরি সাহায্য প্রার্থনার উপায় হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে।

    সারাংশ

    খতমে খাজেগান একটি বিদআতি আমল, যদিও কিছু মানুষ এটিকে বৈধ মনে করে পালন করে থাকেন। এটি মূলত সূরা ও দো’আ পাঠের মাধ্যমে কঠিন পরিস্থিতি থেকে মুক্তি ও মনোকামনা পূরণের জন্য করা হয়। তবে এটি কুরআন ও হাদীসে সরাসরি প্রমাণিত নয়, যার ফলে এটি বিদআত। ইসলামে আমল ও ইবাদতের ক্ষেত্রে তাওক্বীফি (ওহি নির্ভর) হওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই মুসলিমদের উচিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাত অনুসরণ করে আমল করা।

    প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী (FAQ)

    খতমে খাজেগান কী?

    খতমে খাজেগান একটি সূফি প্রার্থনা পদ্ধতি, যা নির্দিষ্ট কিছু সূরা ও দো‘আ পাঠের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা হয়।

    খতমে খাজেগান পড়ার নিয়ম কী?

    খতমে খাজেগান পড়ার নিয়মাবলী রয়েছে, যা উপরের নিবন্ধে বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

    খতমে খাজেগান পড়া কি বিদআত?

    হ্যাঁ, খতমে খাজেগান পড়া বিদআত হিসেবে গণ্য করা হয় কারণ এটি সরাসরি কুরআন ও হাদীস থেকে প্রমাণিত নয়।

    খতমে খাজেগান এর উপকারিতা কী?

    প্রচলিত মতে, খতমে খাজেগান পড়া কঠিন পীড়া ও বিপদাপদ থেকে মুক্তি লাভের জন্য উপকারী বলে ধরা হয়, তবে এর কোনো সহীহ প্রমাণ নেই।

    আরো পড়ুন:


    শেয়ার করুন

    Leave a Comment