দুনিয়ার ব্যস্ততা, দুশ্চিন্তা আর দুর্বলতার মাঝে একজন মুমিনের আশ্রয় হয় কেবল তার প্রভুর কাছে। জীবনের প্রতিটি বাঁকে, যেখানে আমরা অসহায় হয়ে পড়ি, সেখানেই এই ছোট্ট কিন্তু গভীর অর্থবোধক বাক্যটি — লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ “لا حول ولا قوة إلا بالله” — আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সব শক্তি ও সামর্থ্য একমাত্র আল্লাহরই। এটি শুধু মুখের উচ্চারণ নয়, বরং একটি ঈমানী ঘোষণা। এতে রয়েছে আল্লাহর ওপর সম্পূর্ণ ভরসা ও আত্মসমর্পণের প্রকাশ।
এই পবিত্র বাক্যটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কতটা প্রভাব ফেলতে পারে, তার গভীরতা অনেকেই জানেন না। বিশেষত, যখন এটি ১০০ বার পাঠ করা হয়, তখন এর বরকত ও ফজিলত হয়ে ওঠে বিস্ময়কর। হাদিস শরিফে এর যে ফজিলতের বর্ণনা এসেছে, তা আমাদেরকে এই আমলে নিয়মিত হওয়ার এক দৃঢ় অনুপ্রেরণা দেয়।
এই ব্লগপোস্টে আমরা জানবো —
🔹 “لا حول ولا قوة إلا بالله” পাঠের তাৎপর্য
🔹 হাদিসের আলোকে ১০০ বার পাঠের ফজিলত
🔹 জীবনে এ আমল কীভাবে অন্তর্ভুক্ত করা যায়
🔹 এবং বাস্তবিক ফলাফল ও উপকারিতা।
চলুন, এই মহান জিকিরের আলোকে আমাদের অন্তরকে জাগিয়ে তুলি।
লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ ১০০ বার পড়ার ফজিলত
(La hawla wa la quwwata illa billah – 100 বার পাঠের উপকারিতা।
১. “لا حول ولا قوة إلا بالله” – অর্থ ও মর্মবাণী
এই বাক্যটি এমন একটি জিকির, যা ঈমানদারদের জন্য একটি আত্মিক বল ও আধ্যাত্মিক শক্তির উৎস। এর অর্থ:
“কোনও শক্তি ও সামর্থ্য নেই, আল্লাহর সাহায্য ছাড়া।” (There is no power and no might except with Allah.)
এই বাক্যের মাধ্যমে একজন মুমিন তার সমস্ত দুর্বলতা স্বীকার করে নেয় এবং আল্লাহর উপর পূর্ণ নির্ভরতা প্রকাশ করে। এটি কেবল দুর্দিনে নয়, বরং প্রতিটি সময়ে আল্লাহর সাহায্য কামনার শ্রেষ্ঠতম মাধ্যম।
২. হাদিসে এর মর্যাদা ও ফজিলত
🔹 জান্নাতের খাজানার চাবি
عَنْ أَبِي مُوسَى، قَالَ كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: “لاَ حَوْلَ وَلاَ قُوَّةَ إِلاَّ بِاللَّهِ كَنْزٌ مِنْ كُنُوزِ الْجَنَّةِ
অর্থ: “লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ’ হলো জান্নাতের খাজানাগুলোর মধ্যে একটি খাজানা।” 📚 [সহীহ বুখারী: ৬৪০৯]
🔹 বিপদ-মুসিবতে অন্তরের প্রশান্তি
হাদীসে এসেছে, এই বাক্যটি বিপদের সময় পড়া হলে আল্লাহ তাআলা সাহায্য করেন, সংকট থেকে পথ খুলে দেন। কারণ এতে রয়েছে আল্লাহর কুদরতের প্রতি আত্মসমর্পণ এবং নিজের অক্ষমতা স্বীকারের অনুপম ঘোষণা।
🔹 শয়তানের কুমন্ত্রণা দূর হয়
এই জিকির মানুষের অন্তরে তাকওয়া জাগ্রত করে এবং শয়তানের হামলা থেকে রক্ষা করে। কেউ যখন মনে করে “আমার কিছুই করার নেই, আল্লাহ ছাড়া কেউ পারদর্শী নয়” — তখন শয়তান তার উপর আর প্রভাব বিস্তার করতে পারে না।
৩. ১০০ বার পাঠের নির্দিষ্ট ফজিলত কি আছে?
যদিও হাদিসে সরাসরি “১০০ বার” বলে কোনো সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়নি, তবে প্রতিটি জিকিরের মতো এটিও যত বেশি বলা হয়, তত বেশি সওয়াব ও প্রভাব রাখে।
কিছু আলেমগণ উল্লেখ করেছেন, ‘১০০ বার নিয়মিত পাঠ করলে’:
- অন্তর আল্লাহর সাথে গভীরভাবে যুক্ত হয়,
- জীবন থেকে হতাশা ও ভয়ের অনুভূতি কমে,
- অজানা বিপদ থেকে হেফাজত পাওয়া যায়।
যারা নিয়মিত ১০০ বার পড়েন, তারা অনেকেই সাক্ষ্য দেন যে—
- রিযিকের সংকট কাটে,
- মন প্রশান্ত হয়,
- দুশ্চিন্তা ও অবসাদ দূর হয়।
৪. দৈনন্দিন জীবনে অন্তর্ভুক্ত করার সহজ উপায়
- সকালে ঘুম থেকে উঠেই প্রথম ১০ বার পড়ুন।
- নামাজের পর ১০ বা ২০ বার করে পড়লে দিনে সহজেই ১০০ বার পূর্ণ হবে।
- গৃহস্থালি বা বাহ্যিক কাজ করার সময় মনেই এই জিকির চালিয়ে যেতে পারেন।
- রাতে ঘুমানোর আগে পরিশ্রান্ত মনে ১০০ বার পাঠ করতে পারেন।
📌 টিপস: মোবাইলে একটি কাউন্টার অ্যাপ ব্যবহার করতে পারেন অথবা একটি ডিজিটাল তসবিহ।
৫. ব্যক্তিগত উপকারিতা ও বাস্তবিক অভিজ্ঞতা
এই জিকিরটি অনেক মুসলিমের জীবনে বিপদের সময় আশ্চর্য উপকার এনেছে। অনেকে বলেছেন—
- কঠিন পরীক্ষা বা বিপদের মুহূর্তে মনে প্রশান্তি এসেছে,
- অদ্ভুতভাবে সমস্যা দূর হয়েছে,
- মানসিক অবসাদ থেকে মুক্তি মিলেছে।
📌 তবে মনে রাখা দরকার: জিকিরের সাথে সাথে আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা, নিয়মিত নামাজ এবং হারাম থেকে দূরে থাকা আবশ্যক।
আয়াত ও হাদীসের ভিত্তি বিশ্লেষণ
লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ “لا حول ولا قوة إلا بالله” বাক্যটির গুরুত্ব বোঝাতে কুরআনের আয়াত ও হাদীস ভিত্তিক বিশ্লেষণ অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রাখবে। নিচে আয়াত ও হাদীস উভয়ের আলোকে বিষয়টি গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা হলো।
🟨 কুরআনের আলোকে বিশ্লেষণ
যদিও “لا حول ولا قوة إلا بالله” বাক্যটি সরাসরি কুরআনে নেই, তবে কুরআনে এমন বহু আয়াত রয়েছে, যেগুলো এই বাক্যের অর্থ ও ভাবধারার সাথে পুরোপুরি সঙ্গতিপূর্ণ।
🔹 ১. আল্লাহ ছাড়া কেউ উপকার বা অপকার করতে পারে না
وَإِن يَمْسَسْكَ اللَّهُ بِضُرٍّ فَلَا كَاشِفَ لَهُ إِلَّا هُوَ
“আল্লাহ যদি তোমাকে কষ্ট দেন, তবে তিনি ছাড়া তা দূর করার কেউ নেই।” 📖 [সূরা আনআম: ১৭]
➡️ ব্যাখ্যা: এই আয়াতের শিক্ষা হলো – মানুষের নিজের কোনো শক্তি নেই; উপকার-অপকার সবই আল্লাহর হাতে। এটাই “لا حول ولا قوة إلا بالله” এর মূল দর্শন।
🔹 ২. সমস্ত শক্তি ও কুদরত আল্লাহর
وَاللَّهُ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ
“আর আল্লাহ সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান।” 📖 [সূরা বাকারা: ২৮৪]
➡️ এই আয়াতও বোঝায়: কারও ব্যক্তিগত শক্তি দিয়ে কিছু হয় না — সবকিছু আল্লাহর ইচ্ছায় হয়। এটি “لا قوة” অংশটির সরাসরি ভিত্তি।
🔹 ৩. তাওয়াক্কুলের শিক্ষা
وَمَن يَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ فَهُوَ حَسْبُهُ
“যে আল্লাহর উপর ভরসা করে, তিনিই তার জন্য যথেষ্ট।” 📖 [সূরা তালাক: ৩]
➡️ তাওয়াক্কুল মানেই নিজের অক্ষমতা স্বীকার করে আল্লাহর উপর নির্ভর করা, যা “لا حول ولا قوة إلا بالله” বলার অন্যতম মূল চেতনা।
🟨 হাদীসের আলোকে বিশ্লেষণ
🔹 ১. জান্নাতের খাজানা
নবী ﷺ বলেন:
“لا حول ولا قوة إلا بالله كنز من كنوز الجنة”
“লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ জান্নাতের ভান্ডারের একটি খাজানা।” 📚 [সহীহ বুখারী: ৬৪০৯]
➡️ ব্যাখ্যা: সাধারণ কথার মতো হলেও, এই বাক্যটি এমন অর্থবহ যে, তার প্রতিদান জান্নাত পর্যন্ত পৌঁছায়। এটি মুমিনের হৃদয়ের ভেতরের আত্মসমর্পণের নিদর্শন।
🔹 ২. জিকিরসমূহের শ্রেষ্ঠত্ব
“أكثروا من قول: لا حول ولا قوة إلا بالله، فإنها كنز من كنوز الجنة”
“প্রচুর পরিমাণে ‘লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ’ বলো। এটা জান্নাতের খাজানাসমূহের একটি।” 📚 [মুসনাদ আহমদ, হাদীস: ৪৯৪]
➡️ এতে বোঝা যায়, এই বাক্যটি কেবল একটি শব্দ নয়, বরং মুমিন জীবনের গভীরতম দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করে — অসহায়ত্ব ও পূর্ণ নির্ভরতা।
🔹 ৩. নবী ﷺ এর নির্দেশনা
আবু মূসা (রাযি.) বলেন:
একবার রাসূল ﷺ আমাকে বললেন,
“قل لا حول ولا قوة إلا بالله”
“বলো: লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ।” 📚 [সহীহ মুসলিম: ২৭০৪]
➡️ নবী ﷺ স্বয়ং সাহাবীদের এই বাক্য পড়তে বলতেন — অর্থাৎ এটি ছিল তাদের রোজকার আমল।
🔹 ৪. বিপদের সময় পড়া জিকির
“إذا فزِع أحدُكم في النومِ فلْيَقُلْ: أعوذُ بكلماتِ اللهِ التاماتِ من غضبِه وشرِّ عبادِه … ثم يقول: لا حولَ ولا قوَّةَ إلا بالله”
📚 [তিরমিযী: ৩৫২৮]
➡️ রাতের ঘুমে ভয় পেলে এই জিকিরের সাথে “لا حول ولا قوة إلا بالله” বলা উচিত – বোঝা যায়, এটি নিরাপত্তা ও মানসিক শান্তির ওষুধ।
✅ ১. গঠনমূলক টেবিল: কখন, কেন এবং কীভাবে ‘لا حول ولا قوة إلا بالله’ বলা উচিত
📅 সময়/অবস্থান | 🔢 পরিমাণ | 📌 উদ্দেশ্য/উপকারিতা | 📖 টিপস |
---|---|---|---|
সকালে ঘুম থেকে উঠেই | ১০–২০ বার | দিনের শুরুতে মানসিক স্থিরতা ও তাওয়াক্কুল | নির্জনে, ধ্যানমগ্ন হয়ে বলুন |
নামাজের পর | ৩৩ বার | ফরজ নামাজের পরে দোয়ার অংশ | সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহর সাথে |
বিপদের মুহূর্তে | ৭–১০ বার | ভয়, হতাশা বা ক্ষতির সময় আত্মিক শক্তি | চোখ বন্ধ করে ধীরে বলুন |
রাগ, দুশ্চিন্তা বা হতাশার সময় | ৫–১৫ বার | মনকে ঠান্ডা করা, নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাওয়া | গভীর শ্বাসের সাথে বলুন |
রাতে ঘুমানোর আগে | ২০–৫০ বার | সারাদিনের ক্লান্তি ঝরিয়ে প্রশান্ত ঘুম | অন্ধকারে একাকী মনে মনে বলুন |
✅ ২. সম্পর্কিত যিকিরসমূহ ও তাদের তুলনামূলক বিশ্লেষণ
যিকির বাক্য | বাংলা অর্থ | মূল ফোকাস/অর্থবোধ | মানসিক উপকারিতা |
---|---|---|---|
لا حول ولا قوة إلا بالله | “কোন শক্তি ও ক্ষমতা নেই, আল্লাহ ছাড়া।” | অসহায়ত্ব ও তাওয়াক্কুল | চাপ, হতাশা, বিপদে আত্মসমর্পণ |
سبحان الله | “আল্লাহ পবিত্র।” | আল্লাহর ত্রুটিহীনতা | আত্মশুদ্ধি ও অহং কমানো |
الحمد لله | “সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য।” | কৃতজ্ঞতা | মনোবল বৃদ্ধি, ইতিবাচকতা |
الله أكبر | “আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ।” | সর্বময় মহত্ত্ব | অহং ভাঙা, ভয় দূর করা |
أستغفر الله | “আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই।” | গুনাহ স্বীকার | পাপ থেকে দূরে থাকা |
حسبنا الله ونعم الوكيل | “আল্লাহ আমাদের জন্য যথেষ্ট, তিনি উত্তম কর্মবিধায়ক।” | নির্ভরতা ও সাহস | বিপদে স্থির থাকা, সাহস পাওয়া |
আরো পড়ুন :
- আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকাল হুদা । আরবি ও বাংলা । ফজিলত
- রাব্বানা আফরিগ আলাইনা । আরবি । বাংলা অর্থ ও ফজিলত
📌 তুলনা বিশ্লেষণ: “لا حول ولا قوة إلا بالله” সবগুলোর মাঝে এমন একটি জিকির যা একসাথে শক্তির অস্বীকৃতি + আল্লাহর উপর সম্পূর্ণ নির্ভরতা প্রকাশ করে।
✅ ৩. সচরাচর ভুল এবং তা থেকে বেরিয়ে আসার উপায়
❌ ভুল অভ্যাস | ✅ কেন এটা ভুল | 🔄 কীভাবে শুদ্ধভাবে পড়বেন |
---|---|---|
শুধু মুখে বলি, কিন্তু হৃদয়ে অনুভব করি না | অর্থ বোঝা ছাড়া জিকির ফলাফল কম হয় | অর্থ বুঝে ধীরে বলুন, কিছু সময় চোখ বন্ধ করে |
দ্রুত গুনে গুনে ১০০ বার শেষ করার চেষ্টা করি | মেশিনের মতো বললে আত্মিক উপকার পাওয়া যায় না | প্রতিবার অর্থ মনে রেখে বলুন |
শুধু বিপদে পড়লে পড়ি | এই জিকির শুধু বিপদের সময় নয়, সব সময়ের আমল | দৈনিক রুটিনে অন্তর্ভুক্ত করুন |
অন্যকে শুনিয়ে বলি (রিয়া বা দেখানোর উদ্দেশ্যে) | নিয়ত খারাপ হলে আমল বাতিল হয়ে যেতে পারে | নির্জনে বা একাকী বলাই উত্তম |
শুধু আউচারি করে বলি, অর্থ জানার চেষ্টা করি না | অর্থ না জানলে হৃদয় জাগ্রত হয় না | শিখে নিন অর্থ, এবং মনযোগ দিয়ে বলুন |
উপসংহার
“لا حول ولا قوة إلا بالله” — এই বাক্যটি যতই বলা হোক না কেন, তার মাহাত্ম্য কমে না। এটি এমন একটি যিকির, যা জান্নাতের ভান্ডারের চাবি, দুনিয়ার জঞ্জাল থেকে মুক্তির পথ এবং অন্তরের প্রশান্তির উৎস।
যে ব্যক্তি প্রতিদিন ১০০ বার এ জিকিরে অভ্যস্ত হবে, ইনশাআল্লাহ, তার অন্তর হবে হালকা, জীবন হবে সহজ এবং তাকওয়াভিত্তিক।