নামাজ মুসলমানদের জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। নামাজের সময় বিভিন্ন শিষ্টাচার পালন করা অত্যাবশ্যক। এর মধ্যে নামাজরত ব্যক্তির সামনে দিয়ে যাওয়ার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নামাজরত ব্যক্তির সামনে দিয়ে অতিক্রম করার কিছু নির্দিষ্ট বিধান রয়েছে। এই ব্লগ পোস্টে আমরা এই বিধানগুলি আলোচনা করব, কুরআন ও হাদিসের আলোকে নামাজের শিষ্টাচার, সুতরা ব্যবহারের নিয়ম এবং অন্যান্য বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
নামাজে সুতরা ব্যবহার কেন গুরুত্বপূর্ণ
নামাজরত ব্যক্তির সামনে দিয়ে অতিক্রম করা ইসলামে স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এর পেছনে থাকা মূল কারণ হলো, নামাজরত ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে থাকে, এবং কোনো ব্যক্তি তার সামনে দিয়ে অতিক্রম করলে তা তার মনোযোগ ব্যাহত করতে পারে। তাই ইসলাম এ বিষয়ে কঠোর নির্দেশনা প্রদান করেছে।
নামাজের সামনে দিয়ে যাওয়ার বিধান কী?
নামাজরত ব্যক্তির সামনে দিয়ে অতিক্রম করা মাকরূহে তাহরিমি, অর্থাৎ নিষিদ্ধ। ইসলামের বিধান অনুযায়ী, যদি নামাজরত ব্যক্তি সুতরা (খুঁটি, দেয়াল, বা অন্য কিছুর ব্যবহার) না করে, তবে তার সামনে দিয়ে অতিক্রম করা মহাপাপ হিসেবে গণ্য হবে। তবে সেজদার স্থান থেকে চার হাত দূরত্বে যদি কেউ অতিক্রম করে, তাহলে সেটা বৈধ বলে গণ্য হয়।
নামাজি ব্যক্তির সামনে দিয়ে যাওয়ার হাদিস
নামাজরত ব্যক্তির সামনে দিয়ে অতিক্রম করা থেকে বিরত থাকার জন্য বহু হাদিসে নির্দেশনা রয়েছে। কিছু উল্লেখযোগ্য হাদিস নিচে দেওয়া হলো:
১. আবু জুহাইম (রা.) থেকে বর্ণিত:
قَالَ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم لَوْ يَعْلَمُ الْمَارُّ بَيْنَ يَدَىِ الْمُصَلِّى مَاذَا عَلَيْهِ لَكَانَ أَنْ يَقِفَ أَرْبَعِينَ خَيْرًا لَهُ مِنْ أَنْ يَمُرَّ بَيْنَ يَدَيْه.( أخرجه مسلم،১১৬০)
“নবী (স.) বলেছেন, ‘যদি কেউ জানতো যে, নামাজরত ব্যক্তির সামনে দিয়ে অতিক্রম করার পাপ কত বড়, তবে সে চল্লিশ দিন দাঁড়িয়ে থাকার চেয়ে অতিক্রম না করাটাকে উত্তম মনে করত।'”
(সহিহ মুসলিম: ১১৬০)
২. আবু সাঈদ খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিত:
أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- قَالَ « إِذَا كَانَ أَحَدُكُمْ يُصَلِّى فَلاَ يَدَعْ أَحَدًا يَمُرُّ بَيْنَ يَدَيْهِ وَلْيَدْرَأْهُ مَا اسْتَطَاعَ فَإِنْ أَبَى فَلْيُقَاتِلْهُ فَإِنَّمَا هُوَ شَيْطَانٌ. ( أخرجه مسلم،1156)
“নবী (স.) বলেছেন, ‘যখন তোমাদের কেউ নামাজে দাঁড়ায়, তখন যেন কেউ তার সামনে দিয়ে অতিক্রম করতে না দেয়। যদি কেউ চেষ্টা করে, তবে তাকে বাধা দাও, কেননা সে শয়তান।'”
(সহিহ মুসলিম: ১১৫৬)
হানাফি মাযহাবে নামাজের সামন দিয়ে যাওয়ার বিধান
১. নামাজরত ব্যক্তির সামনে দিয়ে অতিক্রম করা তাহরিমি মাকরূহ (নিষিদ্ধ)। যদি নামাজরত ব্যক্তি সুতরা (কোনো বাধা, যেমন খুঁটি বা দেয়াল) ব্যবহার না করে এবং সেই সুতরা ও নামাজরত ব্যক্তির মাঝে কোনো কিছু না থাকে, তাহলে নামাজরত ব্যক্তির সেজদার স্থানের মধ্যে দিয়ে অতিক্রম করলে তা পাপ হবে। (আল-ফিকহ আল-ইসলামী ও আদিলাতুহ, ২/১২৫)
১. যদি কেউ মরুভূমিতে বা বড় মসজিদে নামাজ পড়ে, তাহলে তার সামনে দিয়ে অতিক্রম করা হারাম, বিশেষত তার পা থেকে সেজদার স্থান পর্যন্ত। যদি সে কোনো ঘর বা ছোট মসজিদে নামাজ পড়ে (যা ৪০ হাতের কম), তবে তার পা থেকে কিবলার দেয়াল পর্যন্ত অতিক্রম করা হারাম, কারণ এটি একটি সামগ্রিক স্থান হিসেবে বিবেচিত হয়, যদি সুতরা না থাকে।
তবে যদি সুতরা থাকে, সুতরার পেছন দিয়ে অতিক্রম করা কোনো সমস্যা নয়। বড় মসজিদ বা মরুভূমি একক স্থান হিসেবে বিবেচিত হয় না, কারণ এটি পথচারীদের জন্য কষ্টকর হতে পারে। তাই সেজদার স্থান পর্যন্তই অতিক্রম না করার সীমাবদ্ধতা রাখা হয়েছে।
৩. মালিকি মাযহাব অনুযায়ী, যদি কেউ সুতরার পাছনে নামাজ পড়ে, তবে সুতরা ও নামাজীর মধ্যে দিয়ে অতিক্রম করা হারাম। কিন্তু সুতরার পেছন দিয়ে অতিক্রম করা বৈধ। যদি কেউ সুতরা ছাড়া নামাজ পড়ে, তবে কেবল তার দাঁড়ানোর স্থান, রুকু এবং সেজদার স্থানের মধ্যে দিয়ে অতিক্রম করা নিষিদ্ধ।
৪. শাফি মাহহাব অনুযায়ী, সুতরার সামনে তিন হাত বা এর চেয়ে কম দূরত্বের মধ্যে দিয়ে অতিক্রম করা হারাম। (আল-ফিকহ আল-ইসলামী ও আদিলাতুহ, ২/১২৭)
নামাজরত ব্যক্তির সামনে দিয়ে যাওয়ার শাস্তি
হাদিসের আলোকে দেখা যায়, নামাজরত ব্যক্তির সামনে দিয়ে অতিক্রম করা অত্যন্ত গর্হিত কাজ। নবী করিম (স.) এর কথায় স্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে, এই কাজটি এতোটাই পাপ যে, চল্লিশ দিন অপেক্ষা করাও এর চেয়ে উত্তম। এটি শুধু একটি শিষ্টাচার লঙ্ঘন নয়, বরং এটি নামাজের শুদ্ধতার উপরও প্রভাব ফেলতে পারে।
নামাজী ব্যক্তির কতটুকু সামনে দিয়ে যাওয়া যায়?
যদি নামাজরত ব্যক্তি সুতরা ব্যবহার না করেন, তবে তার সামনে দিয়ে সেজদার স্থান (চার হাত পরিমাণ) পর্যন্ত অতিক্রম করা হারাম। চার হাত পরিমাণ দূরত্বের বাইরে থেকে অতিক্রম করা মাকরূহ নয়। তবে উত্তম হলো, সামনে দিয়ে না গিয়ে পাশ দিয়ে অতিক্রম করা।
সুতরা ব্যবহারের নিয়ম
সুতরা বলতে বোঝানো হয় এমন একটি বস্তু যা নামাজরত ব্যক্তির সামনে রাখলে তা তার মনোযোগকে ব্যাহত করা থেকে রক্ষা করে। সুতরার উদাহরণ হিসেবে দেয়াল, খুঁটি, চেয়ার, বা কোনো বস্তু ব্যবহৃত হতে পারে। সুতরা ব্যবহার করলে তার পরবর্তী অংশ দিয়ে অতিক্রম করা বৈধ।
এফএকিউ
প্রশ্ন ১: নামাজরত ব্যক্তির সামনে দিয়ে অতিক্রম করলে কি নামাজ ভেঙে যাবে?
উত্তর: নামাজরত ব্যক্তির সামনে দিয়ে অতিক্রম করলে তার নামাজ ভেঙে যাবে না, তবে এটি একটি গর্হিত কাজ এবং এতে মারাত্মক পাপ হয়।
প্রশ্ন ২: সুতরা ছাড়া নামাজ পড়া কি বৈধ?
উত্তর: হ্যাঁ, সুতরা ছাড়া নামাজ পড়া বৈধ, তবে উত্তম হলো সুতরা ব্যবহার করা।
প্রশ্ন ৩: যদি সুতরা ব্যবহার না করা হয়, তবে কতটুকু দূরত্বে অতিক্রম করা যাবে?
উত্তর: চার হাত দূরত্বের বাইরে থেকে অতিক্রম করা যাবে।
প্রশ্ন ৪: যদি কোনো ব্যক্তি অজান্তে নামাজরত ব্যক্তির সামনে দিয়ে অতিক্রম করে, তবে কী হবে?
উত্তর: যদি কেউ অজান্তে অতিক্রম করে তবে তার কোনো পাপ হবে না, তবে তাকে এই বিষয়টি পরবর্তীতে খেয়াল রাখতে হবে।
প্রশ্ন ৫: মসজিদে নামাজরত ব্যক্তির সামনে দিয়ে অতিক্রম করা কীভাবে এড়ানো যায়?
উত্তর: মসজিদে নামাজরত ব্যক্তির সামনে দিয়ে অতিক্রম করার সময় সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। প্রয়োজনে পাশ দিয়ে ঘুরে যাওয়া উচিত।
উপসংহার
নামাজের শিষ্টাচার রক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নামাজরত ব্যক্তির সামনে দিয়ে অতিক্রম করা ইসলামে গর্হিত এবং পাপ হিসেবে বিবেচিত। তাই প্রত্যেক মুসলমানের উচিত এই বিষয়ে সতর্ক থাকা এবং সুতরা ব্যবহার করে নামাজ আদায় করা।
আরো পড়ুন: