নামাজের নিষিদ্ধ সময়। চার মাযহাবের অভিমত ও বিস্তারিত

পোস্টটি শেয়ার করুন

নামাজ ইসলামের অন্যতম প্রধান ইবাদত। প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা আমাদের উপর ফরজ। নামাজ হল দৈনন্দিন জীবনে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যম। তাই আমাদের উচিত ফরজের পাশাপাশি নফল নামাজও বেশিবেশি আদায় করা। তবে কিছু নির্দিষ্ট সময়ে নামাজ পড়া নিষিদ্ধ। এ বিষয়ে কুরআন, হাদিস এবং ফিকহ শাস্ত্র থেকে আমরা বিস্তারিত জ্ঞান লাভ করা জরুরি। এই নিবন্ধে আমরা নামাজের নিষিদ্ধ সময় নিয়ে আলোচনা করব। হাদিস উল্লেখ করব, এবং বিভিন্ন মাজহাবের ইমামদের মতামত জানব।

নামাজের নিষিদ্ধ সময় বলতে কী বুঝায়?

মূল কথা: নামাজের নিষিদ্ধ সময় বলতে এমন কিছু নির্দিষ্ট মুহূর্ত বোঝানো হয়, যখন নামাজ আদায় করা ইসলামি শরিয়াহ অনুযায়ী অপছন্দনীয় বা হারাম। এই নিষেধাজ্ঞার পেছনে কিছু বিশেষ কারণ রয়েছে, যেমন মুশরিকদের (অবিশ্বাসীদের) উপাসনা সময়ের সাথে মুসলমানদের ইবাদতের পার্থক্য তৈরি করা। আল্লাহর নির্ধারিত সীমা রক্ষা করা।

নামাজের নিষিদ্ধ সময়

নামাজ পড়া নিষিদ্ধ তিনটি সময় নিম্নে বর্ণিত হলো:

  • সূর্য উদিত হওয়ার সময়: সূর্য ওঠা শুরু থেকে প্রায় ১৫-২০ মিনিট পর্যন্ত।
  • সূর্য মধ্য আকাশে থাকা সময়: যোহরের নামাজের আগে, যখন সূর্য ঠিক মাঝ আকাশে অবস্থান করে।
  • সূর্য অস্ত যাওয়ার সময়: সূর্য অস্ত যাওয়ার কয়েক মিনিট আগে থেকে পুরোপুরি অস্ত যাওয়া পর্যন্ত।

হাদিসের আলোকে নামাজের নিষিদ্ধ সময়

হাদিসে স্পষ্টভাবে নামাজের নিষিদ্ধ সময় উল্লেখ করা হয়েছে। নিম্নে কিছু গুরুত্বপূর্ণ হাদিস উল্লেখ করা হলো:

হাদিস

لا صلاةَ بعدَ الصبحِ حتى تطلُعَ الشمسُ، ولا بعدَ العصرِ حتى تغرُبَ الشمسُ ؛ إلا بمكةَ، إلا بمكةَ، إلا بمكةَ

বাংলা অনুবাদ: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “ফজরের নামাজের পর থেকে সূর্য উদিত হওয়া পর্যন্ত এবং আসরের নামাজের পর থেকে সূর্য অস্ত যাওয়া পর্যন্ত কোনো নামাজ নেই। তবে মক্কায় এর ব্যতিক্রম রয়েছে।” (মুসনাদু আহমাদ : ২১৪৬২)

ব্যাখ্যা: নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবাদের শিক্ষা দিয়েছিলেন যে, কোন সময়ে নামাজ পড়া বৈধ এবং কোন সময়ে বৈধ নয়। এ হাদিসে বর্ণিত হয়েছে যে, ফজরের ফরজ নামাজের পর সূর্য উদিত হওয়া পর্যন্ত এবং আসরের ফরজ নামাজের পর সূর্য অস্ত যাওয়া পর্যন্ত নামাজ পড়া নিষিদ্ধ।

কারণ: ১. **সূর্যের পূজার সাথে বিরোধ করা। এই সময়গুলো মুশরিকদের (সূর্য পূজারিদের) উপাসনার সময়। মুসলমানদের জন্য এই সময়ে নামাজ পড়া নিষিদ্ধ করে ইসলাম তাদের থেকে আলাদা একটি পরিচয় তৈরি করেছে।

২. মক্কার বিশেষ মর্যাদা: মক্কায় এই বিধিনিষেধ শিথিল করা হয়েছে, কারণ মক্কা বিশেষ একটি পবিত্র স্থান এবং এখানে কোনো সময়েই নামাজ নিষিদ্ধ নয়।

২. উকবা ইবনে আমের (রাঃ) হতে বর্ণিত:

ثَلَاثُ سَاعَاتٍ كَانَ رَسُولُ اللَّهِ – صلى الله عليه وسلم – يَنْهَانَا أَنْ نُصَلِّي فِيهِنَّ, وَأَنْ نَقْبُرَ فِيهِنَّ مَوْتَانَا: حِينَ تَطْلُعُ الشَّمْسُ بَازِغَةً حَتَّى تَرْتَفِعَ, وَحِينَ يَقُومُ قَائِمُ الظَّهِيرَةِ حَتَّى تَزُولَ الشَّمْسُ, وَحِينَ تَتَضَيَّفُ الشَّمْسُ لِلْغُرُوبِ

অনুবাদ: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন: “তিনটি সময় রয়েছে, যখন তিনি আমাদের নামাজ পড়তে এবং মৃতদের দাফন করতে নিষেধ করেছেন:

  • যখন সূর্য উদিত হয় এবং সম্পূর্ণরূপে উঁচু হয়নি।
  • যখন সূর্য মধ্য আকাশে থাকে (যোহরের আগে)।
  • যখন সূর্য অস্ত যাওয়ার কাছাকাছি হয়।” (সহীহ মুসলিম, হাদিস নম্বর: ৮২৮)

ব্যাখ্যা: এই তিন সময়ে নামাজ পড়া এবং মৃতদের জানাজা দাফন করা নিষিদ্ধ। কারণ:

  • সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সময়ে মুশরিকরা উপাসনা করত।
  • সূর্য মধ্য আকাশে থাকার সময়টি আল্লাহর নির্দিষ্ট সীমারূপে গণ্য।
    এমন সময়ে নামাজ বা দাফনের কাজ বন্ধ রাখা ইসলামের নির্দেশনা।

ইমামদের মতামত

ইসলামের চার মাজহাবের ইমামরা এই নিষিদ্ধ সময় সম্পর্কে প্রায় একই মত পোষণ করেছেন। তবে, তারা কিছু বিশেষ শর্তে নামাজ পড়ার অনুমতি দিয়েছেন।

হানাফি মাজহাবের মতামত

হানাফি মাজহাবের অনুসারে, নামাজের জন্য তিনটি সময় নিষিদ্ধ, যেখানে কোনো ফরজ বা নফল নামাজ আদায় করা হারাম। তবে, কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট অনুমতি রয়েছে। এ সম্পর্কে হানাফি ফিকহের উল্লেখযোগ্য কিতাবগুলোর আলোচনা নিচে দেওয়া হলো:

‘আল-হিদায়া’ (كتاب الصلاة): কিতাবে উল্লেখ করা হয়েছে, “যে সময়গুলোতে নামাজ নিষিদ্ধ করা হয়েছে, সেগুলো মূলত সূর্য উদিত হওয়া, সূর্য মাঝ আকাশে থাকা এবং সূর্য অস্ত যাওয়ার সময়। তবে, কাজা নামাজ এবং জানাজার নামাজের ক্ষেত্রে এই নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য নয়। কারণ, কাজা নামাজ অবশ্যই আদায় করতে হবে।” (সূত্র: আল-হিদায়া, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৪৮।)

‘রদ্দুল মুহতার’ (رد المحتار): “হানাফি মাজহাব মতে, এই সময়গুলোতে নফল নামাজ পড়া নিষিদ্ধ। তবে, যদি কাজা নামাজের প্রয়োজন হয় বা জানাজার নামাজ দ্রুত দাফনের জন্য পড়তে হয়, তা বৈধ। এটি ইসলামের নীতি এবং উদারতার একটি অংশ।” (সূত্র: রদ্দুল মুহতার, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ১২৪।)

কারণ ও ব্যাখ্যা:

  • হানাফি মাজহাব এই নিষেধাজ্ঞার পেছনে তিনটি মূল কারণ তুলে ধরে:
  • মুশরিকদের উপাসনার সময় এড়ানো।
  • আল্লাহর নির্দেশিত সময়কে সম্মান জানানো।

২. মালিকি মাজহাব:

মালিকি মাজহাবের ইমামরা উল্লেখ করেছেন যে, এই সময়গুলোতে নামাজ পড়া সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ, তবে জুমার দিন সূর্য ঢলে পড়ার আগের সময়ে এ নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য নয়।

৩. শাফেয়ি মাজহাব:

শাফেয়ি মাযহাবের মতে, সূর্যোদয়, সূর্য মধ্য আকাশে থাকা এবং সূর্যাস্তের সময়ে নফল নামাজ পড়া নিষেধ, তবে ফরজ নামাজ পড়ার ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই। এটি শাফেয়ি মাযহাবের বিভিন্ন ফিকহি কিতাব ও ইজমার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত। এখানে এই বিষয়ে কিছু কিতাবের উদ্ধৃতি দেওয়া হলো:

১. “আল-মাজমু’ শারহ আল-মুহাযাব” (ইমাম নওয়াউই)

ইমাম নওয়াউই “আল-মাজমু’ শারহ আল-মুহাযাব” কিতাবে লিখেছেন:
“আমরা (শাফেয়ি মাযহাবের আলেমরা) বলি যে, সূর্যোদয়, সূর্য মধ্য আকাশে থাকা এবং সূর্যাস্তের সময়ে সুন্নত বা নফল নামাজ পড়া নিষেধ। তবে যদি ফরজ নামাজ মিস হয়, তাহলে ওই সময়ে ফরজ নামাজ পড়া যাবে।”
(আল-মাজমু’ ৩/৫১)

২. “আল-উম” (ইমাম শাফি)

ইমাম শাফি তার “আল-উম” কিতাবে উল্লেখ করেছেন:
“ফরজ নামাজ একমাত্র নামাজ যা এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসে না। সূর্যোদয়, সূর্য মধ্য আকাশে থাকা এবং সূর্যাস্তের সময়ে ফরজ নামাজ আদায় করা যাবে যদি এটি অনিবার্য হয়।”
(আল-উম ১/২১৫)

৩. “রাওদাত তালিবিন” (ইমাম নিহায়া)

ইমাম নিহায়া তার “রাওদাত তালিবিন” কিতাবে লিখেছেন:
“সূর্যোদয়, সূর্য মধ্য আকাশে থাকা এবং সূর্যাস্তের সময়ে শুধুমাত্র নফল বা সুন্নত নামাজ নিষেধ। ফরজ নামাজ, যেমন ফজর বা আসরের ফরজ, এই সময়ে পড়া যাবে যদি এটি প্রয়োজনীয় হয়।”
(রাওদাত তালিবিন ১/১৮৫)

সংক্ষেপে

শাফেয়ি মাযহাবের মতে, সূর্যোদয়, সূর্য মধ্য আকাশে থাকা এবং সূর্যাস্তের সময়ে ফরজ নামাজ পড়তে কোনো বাধা নেই, তবে সুন্নত বা নফল নামাজ পড়া নিষেধ। এগুলি ঐ সময়ে নিষেধাজ্ঞার মধ্যে পড়ে কারণ এটি সৃষ্টির নির্দিষ্ট সময়, যেখানে মুসলমানদের সূর্যের পূজার মতো কোনো কার্যকলাপে অংশগ্রহণ না করার পরামর্শ দেয়া হয়।

এই নিষেধাজ্ঞা ফরজ নামাজের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, এবং যদি কোন ফরজ নামাজ মিস হয়ে যায়, তবে তা এই সময়ে পড়া যেতে পারে।

৪. হাম্বলি মাজহাব:

হাম্বলি মাজহাব এই নিষিদ্ধ সময়গুলোতে কোনো ধরনের নামাজকে পুরোপুরি নিষিদ্ধ করেছে। তবে, জানাজার নামাজ বা তাওয়াফের দুই রাকাত নামাজ এর ব্যতিক্রম হতে পারে।

নামাজের নিষিদ্ধ সময়: কারণ ও গুরুত্ব

নামাজের নিষিদ্ধ সময় নির্ধারণের পেছনে কিছু কারণ রয়েছে:

  • মুশরিকদের উপাসনার সাথে পার্থক্য রাখা: মুশরিকরা সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের সময় উপাসনা করত। এ সময়ে নামাজ পড়া নিষিদ্ধ করে ইসলামে তাদের থেকে পার্থক্য সৃষ্টি করা হয়েছে।
  • আল্লাহর সীমা রক্ষা করা: সময় নির্ধারণ ইসলামে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি শৃঙ্খলা এবং আনুগত্য প্রদর্শনের একটি উপায়।
  • ইবাদতের একনিষ্ঠতা বজায় রাখা: এসব সময়ে ইবাদত থেকে বিরত থেকে আমরা আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলার শিক্ষা পাই।

প্রশ্নোত্তর

১. ফজরের নামাজের পর নফল নামাজ পড়া কি হারাম?

ফজরের ফরজ নামাজের পর সূর্যোদয় পর্যন্ত কোনো নফল নামাজ পড়া নিষিদ্ধ। তবে, কেউ যদি কাজা নামাজ আদায় করতে চায়, তা অনুমোদিত।

২. সূর্যোদয়ের কতক্ষণ পর নামাজ পড়া যায়?

সূর্যোদয়ের প্রায় ১৫-২০ মিনিট পর নামাজ পড়া যায়। এ সময় সূর্য সম্পূর্ণভাবে উঠতে হয়।

৩. আসরের পর নফল নামাজ পড়া যাবে কি?

আসরের ফরজ নামাজের পর সূর্যাস্ত পর্যন্ত কোনো নফল নামাজ পড়া নিষিদ্ধ। তবে, কাজা নামাজ পড়া যেতে পারে।

৪. কি কারণে এই সময়গুলোতে নামাজ নিষিদ্ধ?

এটি মুশরিকদের উপাসনার সময় হওয়া এবং আল্লাহর সীমা রক্ষা করার জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

উপসংহার

নামাজের নিষিদ্ধ সময়ের প্রতি খেয়াল রেখে নামাজ আদায় করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান। এ সম্পর্কে হাদিস ও ফিকহ শাস্ত্রের দিকনির্দেশনা অনুসরণ করে আমরা সঠিকভাবে নামাজ আদায় করা আবশ্যক। ইসলামের প্রতিটি বিধানের পেছনে একটি বিশেষ জ্ঞান ও হিকমত রয়েছে। তাই, আমাদের উচিত আল্লাহর আদেশ মেনে চলা এবং নামাজের সময় নির্ধারণে সতর্ক থাকা।


পোস্টটি শেয়ার করুন