গুগল এডসেন্স থেকে আয় করা কি হালাল? একটি বিশ্লেষণধর্মী উত্তর

শেয়ার করুন

অনলাইন থেকে আয় বর্তমান সময়ে দ্রুত জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। অনলাইন আয়ের একটি উত্তম উপায় হল গুগল অ্যাডসেন্স। কিন্তু এ ক্ষেত্রে যে প্রশ্নটি বিভিন্নভাবে আমাদের মনে আসে সেটা হল – গুগল এডসেন্স থেকে আয় করা কি হালাল?

আমি বিশ্বাস করি এই প্রশ্নের গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ মুসলিম জীবনে অর্থের যেমন প্রয়োজন তেমনি হালাল উপায়ে উপার্জন করাও আবশ্যক। সেটা গুগল এডসেন্স হোক বা অন্য কোনো ফ্রিল্যান্স জব হোক ।

আমি আমার ওয়েব সাইটের পাঠকদের জন্য এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করছি। এই উত্তরটি ভালোভাবে বুঝার আগে আমাদের বাকি দুটি বিষয় জানতে হবে।

  • অ্যাডসেন্স কি?
  • অ্যাডসেন্স থেকে কিভাবে অর্থ আয় হয়?

গুগল এডসেন্স কি?

গুগল অ্যাডসেন্স (Google AdSense) গুগলের একটি বিশেষ পরিষেবা।
পৃথিবীর সর্ববৃহত বিজ্ঞাপন প্রদর্শনকারী প্ল্যাটফর্ম। সেখান থেকে ওয়েবসাইট, ব্লগ বা ইউটিউব চ্যানেল এড প্রদার্শ করা হয়। এটি কন্টেন্ট ক্রিয়েটর এবং ওয়েবসাইট মালিকদের জন্য একটি জনপ্রিয় আয়ের উৎস। যখন কোনো ওয়েবসাইটে গুগল অ্যাডসেন্স মনিটাইজ হয়, তখন গুগল সেই ওয়েবসাইটে বিজ্ঞাপন প্রদর্শন করার সুযোগ দেয়।

গুগল এডসেন্স থেকে কিভাবে অর্থ আয় হয়?

গুগল বিভিন্ন কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে নির্দিষ্ট হারে অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন পণ্য বা সেবার বিজ্ঞাপন গ্রহণ করে। অতপর সেই বিজ্ঞাপনগুলো গুগল এডসেন্স প্লাটফর্মে মনিটাইজেশন পাওয়া ওয়েব সাইটগুলোতে প্রদর্শন করে।

এড দাতা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে পাওয়া অর্থের কিছু অংশ গুগল সেই ওয়েবসাইটের মালিককে প্রদান করে, যার ওয়েব সাইটে এড প্রদর্শন করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপনে ইপ্রেশন, ক্লিক, কন্টেন্টের সার্চ ভলিউম ও প্রতিযোগিতা গুরুত্বপূর্ণ ফেক্ট।

কী ধরণের এড গুগল প্রদর্শন করে?

গুগল সাধারণত তিনিটি বিষয়ে লক্ষ্য রেখে ভিসিটরের সামনে এড প্রদর্শন করে।

১. ওয়েবসাইটের কন্টেন্ট : ওয়েব সাইটে যে ক্যাটাগরীর কন্টেন্ট রয়েছে এই ওয়েব সাইটে এড প্রদর্শনের ক্ষেত্রে সেটা একটি ফেক্ট। উদাহরণস্বরূপ কোন ব্যক্তি তার ওয়েবসাইটে গেমিং কন্টেন্ট পাবলিশ করলে তার ওয়েবসাইটে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গেম সংক্রান্ত ড প্রদর্শিত হবে। আবার কোন ব্যক্তি তার ওয়েবসাইটে ফুড ব্লগিং করলে তার ওয়েব সাইটে ফুড সংক্রান্ত এড প্রদর্শন হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।

২. ওয়েব সাইট ভিসিটকারীর লোকেশন : যে লোকেশন থেকে কোনো ব্যক্তি কোনো ওয়েবসাইটে ভিজিট করছে সেই লোকেশনটা তার সামনে এড প্রদর্শিত হওয়ার জন্য বিশেষ একটি ফ্যাক্ট। যদি বাংলাদেশ থেকে কোন ব্যক্তি কোনো ওয়েবসাইটে প্রবেশ করে তাহলে সেই সে বাংলাদেশী পণ্য সংক্রান্ত বিজ্ঞাপন দেখতে পাবে। আবার একই কন্টেন্ট যদি কোন ব্যক্তি ইউএসএ থেকে দেখেন, তাহলে ইউএসএ এর কোনো পণ্য সংক্রান্ত বিজ্ঞাপন সেখানে দেখানো হবে। আরব থেকে হলে আরব দেশের কোনো পণ্য দেখানো হবে।

৩. ব্রাউজিং হিস্টোরি : যে ব্যক্তি ওয়েবসাইটটি ব্রাউজ করছেন, তার সামনে এড প্রদর্শিত হওয়ার জন্য তার ব্রাউজিং হিস্টোরি একটি ফ্যাক্ট। তিনি যদি অধিকাংশ ক্ষেত্রে গুগল এ গিয়ে অশ্লীল বিষয়বস্তু সার্চ করেন, তাহলে তার সামনে সেরকম এড পদর্শিত হবে। আবার কোনো ব্যক্তি যদি অনলাইনে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কোনো ইনফরমেটিভ বা এডুকেশনাল বিষয় নিয়ে সার্চ করেন, তাহলে তার সামনে সেই সংক্রান্ত এড প্রদর্শিত হবে।

গুগল এডসেন্স থেকে আয় করা কি হালাল? সাধারণ উত্তর

না, গুগল অ্যাডসেন্স হালাল নয়। তবে সমসাময়িক কিছু স্কলার যেমন মুফতি তারিক মাসউদ সাহেব বলেছেন, গুগল এবং ইউটিউব অ্যাডসেন্স হালাল। যারা হারাম বলেন তাদের পক্ষে যুক্তি ও দলিল আছে। আবার যারা হালাল বলেন তাদের পক্ষেও যুক্তি ও দলিল রয়েছে।

আমার কাছে মনে হয়েছে গুগল এডসেন্স হারাম বলার আগে এটি নিয়ে গভীরভাবে পর্যালোচনা এবং গবেষণা অপরিহার্য। কেননা আমি দেখতে পেয়েছি যারা google এডসেন্স হারাম বলেছেন, তারা এডসেন্সের মৌলিক বিষয় আসয় সম্পর্কে খুব একটা ধারণা-ই রাখেন না। অথচ একটি বিষয় হারাম বলতে হলে সে বিষয়টি খুবই গভীরভাবে বুঝা আবশ্যক।

গুগল এডসেন্স ইনকাম হারাম কেন?

অ্যাডসেন্স থেকে আয়ের ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপন এবং কন্টেন্ট দুটিই হালাল হওয়া আবশ্যক।

১. কন্টেন্ট : কনেন্টন্ট যে কোনো বিষয়ে হালাল বিষয় নিতে তৈরি করা হতে হবে। যেমন ইসলামিক বিষয় বা সত্য সংবাদ ইত্যাদি। কোনো হারাম বিষয় নিয়ে কন্টেন্ট তৈরি করা যাবে না। যেমন নারীদেহ প্রদর্শন, অশ্লীল গল্প, ক্যাসিনো প্রমোট ইত্যাদি।

২. বিজ্ঞাপন : ইসলামে নিষিদ্ধ কোনো বিজ্ঞাপন যদি ওয়েব সাইটে প্রদর্শিত হয়, তাহলে সেই ইনকাম হারাম হবে। যেমন মদ, মহিলাদের ছবিযুক্ত বিজ্ঞাপন ইত্যাদি।

গুগল এডসেন্স হালাল কেন?

যারা Google এডসেন্স কে হালাল বলেন, তাদের যুক্তি হল, বিজ্ঞাপন প্রদর্শনের মূল উদ্দেশ্য হল পণ্যটি প্রদর্শন করা। যাতে মানুষের কাছে তাদের সেবা বা পণ্য অধিক পরিমাণে বিক্রি হয়। এডের সাথে কোনো নারীদেহ প্রদর্শিত হলে সেটা মূল উদ্দেশ্য নয়।

উদাহরণস্বরূপ কোনো সাবান বিজ্ঞাপন বা শ্যাম্পুর বিজ্ঞাপনে যদি কোনো নারীর দেহ প্রদর্শিত হয় তাহলে এমন কোন ব্যক্তি নেই যিনি দোকানে গিয়ে বলবেন, ওই নারীকে আমি কিনতে চাই। প্রত্যেক ব্যক্তি বিজ্ঞাপন দেখার পর সেই সাবান বা শ্যাম্পুঁটির সম্পর্কে ধারণা লাভ করবেন। তিনি কখনো কিনতে চাইলে সেই সাবান বা শ্যাম্পুটি কিনবেন। কাজেই মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে এখানে পণ্য।

অনেক মাসআলা রয়েছে যেখানে মৌলিকভাবে হালালের সাথে আনুষাঙ্গিকভাবে ( তাবে ) কোনো হারাম যুক্ত হলে মূল জিনিসটি হারাম হয় না।

অন্যভাবে বলা যায় গুগল এডসেন্সের উদাহরণ হলো কোনো ব্যক্তির কাছে একটি দোকান ভাড়া ( ইজারা ) দেওয়া মত। ভাড়া নেওয়ার পর সেই ব্যক্তি যদি দোকানটিতে কোনো হারাম পণ্য বিক্রি করে, তাহলে ভাড়া হিসাবে পাওয়া টাকা আমার জন্য হারাম নয়। এভাবে আমি আমার ওয়েবসাইটে বিজ্ঞাপন প্রকাশের স্থানটি গুগলকে দিয়ে দিলাম। অতঃপর গুগল আমাকে সেখানে বিজ্ঞাপন পরিবেশনের বিনিময়ে কিছু টাকা প্রদান করে থাকে। এটা সেই ভাড়া দেওয়া দোকানের মতই হয়ে গেল।

এক্ষেত্রে গুগল এডসেন্স থেকে আয় হালাল হওয়ার জন্য কেবল একটি শর্ত গ্রহণযোগ্য। সেটি হল কন্টেন্ট হালাল হওয়া। এড হালাল কিনা সেটি দেখা খুব দরকার পড়ে না।

তদুপরি গুগল যে এড গুলো পরিবেশন করে থাকে, তারা তাদের বিশ্বাস এবং ধারণা অনুযায়ী যে সমস্থ এড সমাজ ও মানুষের জন্য ক্ষতিকর সেগুলো তারা পরিবেশন করে না। এরপরও এডসেন্স একাউন্টে বিভিন্ন ক্যাটাগরির এড সেটআপ করার সিস্টেমরয়েছে। কোনো ওয়েবসাইটের মালিক তার ওয়েব সাইটে যে ধরনের এড প্রদর্শন করতে অনাগ্রহী সেটি তিনি সেখান থেকে ব্লক করে দিতে পারেন।

গুগল এডসেন্স থেকে আয় করার হালাল উপায় কি?

আপনি আমাদের পোস্টিটি সম্পূর্ণ পড়ে থাকলে বুঝতে পারবেন, অ্যাডসেন্স থেকে আয়ের হালাল উপায় আসলে নেই। যদি আপনি সাধারণভাবে চলে আসা ফতোওয়া অনুসণ করেন। আর যদি আপনি আমরা আলেমদের দ্বিতীয় যে মতটি আলোচনা করেছি সেটা অনুরণ করেন তাহলে নিম্নের বিষয়গুলো ফলো করে হালালভাবে এডসেন্স থেকে আয় করতে পারেন।

১. কনটেন্ট তৈরি করার সময় অবশ্যই হালাল ক্যাটাগরির কন্টেন্ট তৈরি করতে হবে। এ জন্য গুগল এডসেন্স একাউন্ট থেকে লিল্টার করে হারাম বা অবাঞ্ছিত এডগুলো ব্লক করতে হবে।

এডসেন্সের হালাল বিকল্প

আপনি গুগল অ্যাডসেন্সে ওয়েব সাইট মনিটাইজ না করেও একটি ওয়েবসাইট থেকে বিভিন্ন উপায়ে অর্থ উপার্জন করতে পারেন। নিচে কয়েকটি দেওয়া হল।

অ্যাফিলিয়েট মার্কেটিং

অ্যাফিলিয়েট মার্কেটিং মানে কোনো পণ্য বা পরিষেবার রিভিউ করা। আপনার অ্যাফিলিয়েট লিংকে কেউ কোনো পণ্য ক্রয় করলে করে এমন লভ্যাংশ থেকে আপনি একটি অংশ পাবেন।

তাই অ্যাফিলিয়েট মার্কেটিং করে হালাল আয় সম্ভব। শুধুমাত্র মার্কেটারকে সব সময় হালার পণ্য ও সেবার রিভিউ লিখতে হবে।

স্পন্সরশিপ থেকে অর্থ উপার্জন

ব্লগিংয়ের করে আয়ের আরেকটি উপায় হল স্পনসরশিপ। আপনার ওয়েব সাইটে ভালো ভিসিটর আসলে আপনি লোকাল কোনো কোম্পানী বা প্রতিষ্টানের বিজ্ঞাপন প্রচার করতে পারেন।

আপনি যদি বিজ্ঞাপন গ্রহণের সময় হালাল পণ্য এবং সেবা বাচাই করেন, তাহলে স্পন্সরশিপ থেকে অর্জিত অর্থও হালাল হবে।

ব্যাকলিংক বিক্রি

আপনার ওয়েবসাইট Google-এ ভালো রেঙ্কে থাকলে। সাইটের DA এবং PA ভালো থাকলে, অন্যান্য ওয়েবসাইটের মালিকরা আপনার সাইটে তার ওয়েব সাইটের একটি লিঙ্ক করতে আপনার সাথে যোগাযোগ করবে। বিনিময়ে তরা ভালো পরিমাণ অর্থ প্রদান করবে। এটাকে ব্যাকলিংক সেল বলা হয়।

ওয়েবসাইট বিক্রয়

একটি ওয়েবসাইটে কাজ করার পরে সেই সাইটটি বিক্রি করতে পারেন। সেক্ষেত্রে সাইটের কনটেন্ট-গুগল রেঙ্ক হিসাবে আপনার ওয়েব সাইটের দাম নির্ধারণ করতে পারবেন।

ওয়েবসাইটের কন্টেন্ট হালাল হলে তা বিক্রি করাও হালাল হবে। এ জন্য শুরু থেকেই ইসলামের নিষিদ্ধ বিষয়গুলো পরিহার করে কাজ করতে হবে।

কিছু সাধারণ প্রশ্ন উত্তর

গুগল এ ডসেন্সের মাধ্যমে আয় করা কি হালাল?

এই বিষয়টি নিয়ে মুসলিম স্কলারদের মধ্যে দুটি অভিমত রয়েছে। একটি মত অনুযায়ী হারাম। আর অন্য মত অনুযায়ী ডসেন্সের মাধ্যমে আয় করা হালাল।

কোন ধরনের বিজ্ঞাপন হারাম ?

মদ, জুয়া, শুয়োরের মাংস বা সুদ-ভিত্তিক আর্থিক কর্মকাণ্ড ইত্যাদির পণ্য বা পরিষেবার বিজ্ঞাপন হারাম। এভাবে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি বা মিউজিক ইত্যাদিও হারাম।

আমি কি Google AdSense এর বিজ্ঞাপনের ক্যাটাগরি সিলেক্ট করে দিকে পারব?

হ্যাঁ, Google AdSense আপনার ওয়েবসাইটে প্রদর্শিত বিজ্ঞাপনের ক্যাটাগরি আপনি সিলেক্ট করে দিতে পারবেন। আপনি ক্যাটাগরি ফিল্টার করে আপনার মনমত বিজ্ঞাপন সেট করে দিতে পারেন। সেখান থেকে ইসলামের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ এড ব্লক করে দিতে পারেন।

গুগল অ্যাডসেন্স হালাল বিষয়ে কোন নির্দিষ্ট ফতোয়া আছে কি?

আমাদের জানা মত গুগল এডসেন্স হালাল বিষয়ে কোনো নির্দিষ্ট ফতোয়া নেই।


শেয়ার করুন

Leave a Comment