তায়াম্মুমের ফরজ কয়টি? ও কী কী? শর্তাবলী । প্রাসঙ্গিক আলোচনা

পোস্টটি শেয়ার করুন

ইসলামে তায়াম্মুম একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান। বিশেষ অবস্থায় অজুর বিকল্প হলো তায়াম্মুম। এটি মাটি বা মাটি-জাতীয় উপকরণের সাহায্যে পবিত্রতা অর্জন বৈধ কারী। এই প্রবন্ধে আমরা তায়াম্মুমের ফরজ কয়টি ও শর্ত কী কী এবং তায়াম্মুম কখন জায়েজ, তা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব।

তায়াম্মুমের ফরজ কয়টি?

তায়াম্মুমের ফরজ দুটি। ফরজ হলো কোনো কাজের এমন অংশ যা কাজের অভ্যন্তরে বিদ্যমান থাকে এবং সেটি সম্পন্ন করা আবশ্যক। এটি কাজের অন্তর্ভুক্ত। যেমন তায়াম্মুমের ফরজ হলো :

  • মুখমণ্ডল মাসহ করা: প্রথমবার মাটিতে হাত দিয়ে চাপ দিয়ে সেটা দ্বারা মুখমণ্ডলে মাসাহ করা। মুখের সেই অংশগুলো মাসাহ করতে হবে যা ওজুর সময় ধোয়া আবশ্যক।
  • দুই হাত কনুই পর্যন্ত মাসহ করা: দ্বিতীয়বার মাটিতে হাত দিয়ে চাপ দিয়ে সেটা দ্বারা হাত দুটিকে কনুই পর্যন্ত মাসাহ করতে হবে।

দলিল

আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

“فَلَمْ تَجِدُوا مَاءً فَتَيَمَّمُوا صَعِيدًا طَيِّبًا فَامْسَحُوا بِوُجُوهِكُمْ وَأَيْدِيكُمْ”

” অতপর তোমরা যদি পানি না পাও, তবে পবিত্র মাটি দ্বারা তায়াম্মুম করো। তারপর তা দিয়ে তোমাদের মুখমণ্ডল ও হাতগুলো মাসহ করো।” (সূরা নিসা: ৪৩)

আয়াতের এই নির্দেশ তায়াম্মুমে মুখমণ্ডল ও হাত মাসহ করাকে ফরজ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে, কারণ এটি ওজু বা গোসলের বিকল্প।

الدليل من السنة النبوية

হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসির (রা.) থেকে বর্ণিত:

بعثني النبي صلى الله عليه وسلم في حاجة، فأجنبت، فلم أجد الماء، فتمرغت في الصعيد كما تمرغ الدابة، ثم أتيت النبي صلى الله عليه وسلم فذكرت ذلك له، فقال: إنما يكفيك أن تقول بيديك هكذا، ثم ضرب بيديه الأرض ضربة واحدة، ثم مسح الشمال على اليمين وظاهر كفيه ووجهه
(رواه البخاري ومسلم)

“রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাকে একটি কাজে পাঠালেন। আমি তখন জানাবত অবস্থায় ছিলাম। অতপর পানি পাইনি। তাই আমি মাটিতে গড়াগড়ি করলাম যেমন একটি পশু গড়াগড়ি করে। এরপর নবী (সা.)-এর কাছে এসে ঘটনাটি জানালাম। তিনি বললেন: ‘তোমার জন্য এটি যথেষ্ট ছিল যে, তুমি তোমার দুই হাত দিয়ে এভাবে করতে। অতপর তিনি একবার হাত মাটিতে মেরে দেখালেন তারপর বাম হাত ডান হাতের উপর ও ডান হাত বাম হাতের উপর মাসহ করে, মুখমণ্ডল মাসহ করলেন।'” (সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিম)

ইবনে আব্বাস (রাদি.) থেকে বর্ণিত:

“التيمم ضربة للوجه وضربة لليدين إلى المرفقين”

“তায়াম্মুম হলো মুখমণ্ডলের জন্য একটি আঘাত এবং কনুইসহ দুই হাতের জন্য আরেকটি আঘাত।” (সুনান দারাকুতনি)

তায়াম্মুমের শর্ত কয়টি ও কী কী?

তায়াম্মুম সহীহ হওয়ার জন্য আটটি শর্ত রয়েছে:

প্রথম শর্ত । নিয়ত

১. নিয়তের প্রকৃতি: নিয়ত হলো কোনো কাজ করার জন্য অন্তরে দৃঢ় সংকল্প করা।
২. নিয়তের সময়: তায়াম্মুমের উপকরণে হাত দ্বারা চাপ দেওয়ার সময় নিয়মত করতে হবে।
৩. নিয়ত সহীহ হওয়ার শর্ত তিনটি:

  • ইসলাম বা মুসলিম হওয়া।
  • বুঝ বা বুদ্ধি থাকা।
  • যে উদ্দেশ্যে নিয়ত করা হচ্ছে, তা সম্পর্কে জ্ঞান থাকা।

৪. তায়াম্মুমের নিয়ত সহীহ হওয়ার জন্য তিনটি বিষয়ের যে কোনো একটি থাকা আবশ্যক:

  • পবিত্রতার নিয়ত।
  • নামাজের বৈধতার জন্য নিয়ত।
  • এমন কোনো ইবাদতের নিয়ত, যা পবিত্রতা ছাড়া সহীহ হয় না।

যদি কেউ শুধুমাত্র তায়াম্মুমের নিয়ত করে বা কুরআন পাঠের জন্য তায়াম্মুম করে (যদি সে অপবিত্র – হাদাস আকবর না থাকে), তবে সেই তায়াম্মুম দ্বারা নামাজ পড়া জায়েয হবে না।

দ্বিতীয় শর্ত

তায়াম্মুম বৈধকরাী ওজর বা অপারগতা বিদ্যমান থাকা। যেমন,

১. পানি থেকে এক মাইল বা তার অধিক দূরে থাকা, সেটা তা শহরে হলেও।
২. অসুস্থতা।
৩. এমন ঠাণ্ডা, যা থেকে মৃত্যু বা অসুস্থতার আশঙ্কা থাকে।
৪. শত্রুর ভয়।
৫. তৃষ্ণা।
৬. অল্প পানি রয়েছে সেটা দ্বারা রুটি বানানো আবশ্যক। সেটা সুপ তৈরির জন্য নয়।
৭. পানি আনার সরঞ্জামের অভাব থাকলে বা জানাজার নামাজ বা ঈদের নামাজের সময় চলে যাওয়ার আশঙ্কা থাকলে।

তৃতীয় শর্ত

তায়াম্মুমের বস্তু এমন হতে হবে, যা মাটি জাতীয় এবং পবিত্র, যেমন: মাটি, পাথর বা বালু। কাঠ, রূপা বা সোনা দ্বারা তায়াম্মুম সহীহ নয়।

চতুর্থ শর্ত

তায়াম্মুমে হাত দ্বারা পুরো নির্ধারিত জায়গা মাসাহ করতে হবে।

পঞ্চম শর্ত

হাতের পুরো অংশ বা বেশিরভাগ অংশ দিয়ে মাসাহ করতে হবে। যদি কেবল দুই আঙুল দিয়ে মাসাহ করা হয়, তবে তা সহীহ হবে না। এমনকি যদি বারবার মাসাহ করে পুরো জায়গা মাসাহপূর্ণ করে ফেলে। তবে মাথার মাসাহ ভিন্ন।

ষষ্ঠ শর্ত

দুইবার হাত দ্বারা মাটিতে চাপ মারা। হাতের তালু দিয়ে মাটির উপর দুইবার আঘাত করতে হবে। একই স্থানে দুইবার চাপ মারলেও সমস্যা নেই।

  • তায়াম্মুমের নিয়তে দেহে মাটির সংস্পর্শ আসলে তা দুই আঘাতের স্থলাভিষিক্ত হবে।

সপ্তম শর্ত

হায়েজ, নিফাস বা অন্য কোনো অপবিত্রতার অবসান।

অষ্টম শর্ত

মসাহকে বাধা সৃষ্টি করে এমন বস্তু যেমন মোম বা চর্বি ইত্যাদি তায়াম্মুমের অঙ্গে লেগে না থাকা।

ফরজ ও শর্তের মধ্যে পার্থক্য

ফিকহের দৃষ্টিতে ফরজ এবং শর্ত—এ দুটি এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা কোনো ইবাদত বা কাজের শুদ্ধতার জন্য অপরিহার্য। তবে এগুলোর মধ্যে মৌলিক কিছু পার্থক্য রয়েছে। নিচে উভয়ের পার্থক্য তুলে ধরা হলো:

সংজ্ঞার দিক থেকে পার্থক্য

  • ফরজ: ফরজ হলো ইবাদতের এমন অংশ যা ইবাদতের অভ্যন্তরে বিদ্যমান থাকে এবং সেটি সম্পন্ন করা আবশ্যক। এটি ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত। উদাহরণ: নামাজে রুকু ও সিজদা।
  • শর্ত: শর্ত হলো ইবাদতের শুদ্ধতার জন্য আবশ্যক একটি উপাদান। এটি ইবাদতের বাইরে থাকে। ইবাদত শুরুর আগে এটি পূরণ করতে হয়। উদাহরণ: নামাজের জন্য অজু ও কিবলামুখী হওয়া।

শুরুর আগে ও পরে প্রভাব

  • ফরজ: ফরজ পালন না করলে ইবাদত বাতিল হয়ে যায়, অর্থাৎ সেটি শুদ্ধ হবে না। উদাহরণ: নামাজে সিজদা না করলে নামাজ শুদ্ধ হবে না।
  • শর্ত: শর্ত পূরণ না করলে ইবাদত শুরুই করা যাবে না। উদাহরণ: অজু ছাড়া নামাজ শুরু করা বৈধ নয়।

উদাহরণ দিয়ে পার্থক্য

ইবাদতফরজশর্ত
নামাজরুকু, সিজদাঅজু, কিবলামুখী হওয়া
রোজাসুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোজা রাখারোজার নিয়ত করা
তায়াম্মুমমুখমণ্ডল ও হাত মাসহ করাপবিত্র মাটি ব্যবহার করা

তায়াম্মুম কখন জায়েজ?

১. পানি না পাওয়া: যদি আশপাশে পানির ব্যবস্থা না থাকে এবং তা আনার জন্য যথেষ্ট সময় বা সামর্থ্য না থাকে।

২. অসুস্থতা: যদি পানি ব্যবহারে রোগ বাড়ার আশঙ্কা থাকে বা চিকিৎসকের পরামর্শে পানি ব্যবহার নিষিদ্ধ হয়।

৩. প্রচণ্ড ঠান্ডা: যদি ঠান্ডা এত বেশি হয় যে, পানি ব্যবহারে অসুস্থ হওয়ার শঙ্কা থাকে এবং গরম করার কোনো ব্যবস্থা না থাকে।

৪. তৃষ্ণার জন্য পানি সংরক্ষণ: যদি পানি শুধু পান করার জন্য প্রয়োজন হয় এবং তা দিয়ে অজু করলে তৃষ্ণা মেটানোর জন্য পানি না থাকে।

৫. শত্রুর ভয়: যদি পানি আনতে গেলে শত্রুর আক্রমণের আশঙ্কা থাকে।

উপসংহার

তায়াম্মুম একটি সহজ ও সহনশীল বিধান, যা আল্লাহ তাআলা আমাদের জন্য বিশেষ পরিস্থিতিতে অনুমোদন করেছেন। এটি অজুর বিকল্প হলেও এর শর্তাবলী ও পদ্ধতি যথাযথভাবে মানা আবশ্যক। তাই তায়াম্মুম করার আগে এর বিধান ও প্রক্রিয়া সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান অর্জন করা জরুরি। আল্লাহ আমাদেরকে সঠিকভাবে তাঁর বিধান মেনে চলার তাওফিক দান করুন। আমিন।


পোস্টটি শেয়ার করুন