দরুদে উম্মি । আরবি ও বাংলা । ৫ টি ফজিলত ও গল্প

Share this post

রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর উপর দরুদ পাঠ করা ইমানদারদের জন্য এক মহামূল্যবান আমল। দরুদ পাঠের মাধ্যমে বান্দা তার প্রিয় নবীর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করে এবং আল্লাহর কাছে বিশেষ রহমত ও বরকত লাভ করে। বিভিন্ন ধরনের দরুদ রয়েছে, যার মধ্যে একটি হলো দরুদে উম্মি। এই দরুদ সংক্ষিপ্ত হলেও এর ফজিলত অসীম। বিশেষ করে সহজে মুখস্থ করা যায় বলে অনেক আলেম ও মুমিন দরুদে উম্মি পড়ার পরামর্শ দিয়েছেন।

দরুদে উম্মি এমন এক দরুদ, যা নবী করিম ﷺ-এর জন্য রহমত, দয়া ও শান্তির দোয়া। এটি পড়ার মাধ্যমে বান্দা শুধু সওয়াব অর্জনই করে না, বরং তার জীবনে শান্তি, প্রশান্তি ও বরকতও লাভ করে। এই ব্লগপোস্টে আমরা দরুদে উম্মির আরবি পাঠ, বাংলা উচ্চারণ, অর্থ, ফজিলত, দলিল এবং কিভাবে ও কখন পড়া যায় – তা বিস্তারিত আলোচনা করব।

দরুদে উম্মির আরবি

اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى سَيِّدِنَا مُحَمَّدٍ النَّبِيِّ الأُمِّيِّ وَعَلَى آلِهِ وَسَلِّمْ

বাংলা উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা সাল্লি ‘আলা সাইয়্যিদিনা মুহাম্মাদিন নাবিয়্যিল উম্মিয়্যি ওয়া ‘আলা আলিহি ওয়া সাল্লিম।

অর্থ: “হে আল্লাহ, আমাদের নেতা, উম্মি নবী মুহাম্মাদ ﷺ-এর উপর রহমত বর্ষণ করুন এবং তাঁর পরিবারবর্গের উপরও। আর তাদের উপর সালাম প্রেরণ করুন।”

দরুদে উম্মি
দরুদে উম্মি

ফজিলত

দরুদে উম্মি সংক্ষিপ্ত হলেও এর ফজিলত অসংখ্য হাদিস দ্বারা প্রমাণিত।

  • একবার দরুদ পড়লে আল্লাহ দশবার রহমত প্রেরণ করেন।
  • গুনাহ মাফ হয়, মর্যাদা বৃদ্ধি পায়।
  • নবীর ﷺ শাফা’আতের যোগ্য হয়।
  • কিয়ামতের দিন নবীর ﷺ সান্নিধ্য লাভের উপায়।
  • দুনিয়ার দুশ্চিন্তা কমে, জীবনে বরকত আসে।

দরুদে উম্মির দলিল

হাদিসে এসেছে—

مَنْ صَلَّى عَلَيَّ صَلاَةً وَاحِدَةً صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ عَشْرًا

“যে ব্যক্তি আমার উপর একবার দরুদ পাঠ করে, আল্লাহ তার উপর দশবার রহমত পাঠান।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৩৮৪)

এছাড়া “النبي الأمي” শব্দটি কুরআনে এসেছে (সূরা আল-আ’রাফ: ১৫৭), যা প্রমাণ করে যে উম্মি নবীর উপর দরুদ পড়া একেবারে সহিহ ও গ্রহণযোগ্য আমল।

দরুদে উম্মি পড়ার সময় ও পদ্ধতি

  • নিয়মিত পড়া: যেকোনো সময়, বিশেষ করে নামাজ শেষে, জিকিরের পর, সকালে-সন্ধ্যায়।
  • দরুদে উম্মির বিশেষ সময়:
    • শুক্রবার বেশি বেশি পড়া।
    • দোয়া করার আগে ও পরে পড়া।
    • কোনো প্রয়োজনে মনোযোগ সহকারে পড়া।

এই দরুদে উম্মির ব্যবহারিক উপকারিতা

  • মনকে শান্ত রাখে, দুশ্চিন্তা কমায়।
  • জীবনে বরকত ও সুস্থতা আনে।
  • রিযিক বৃদ্ধি পেতে সহায়ক হয়।
  • নবীর ﷺ প্রতি ভালোবাসা দৃঢ় হয়।

দরুদে উম্মির ইতিহাস ও নামের কারণ

দরুদে উম্মি নবী ﷺ-এর উপর দরুদ পাঠের একটি সংক্ষিপ্ত ও সহিহ রূপ। “উম্মি” শব্দটি এসেছে আরবি الأُمِّيّ থেকে, যার অর্থ—

  • যার কোনো পার্থিব শিক্ষক নেই।
  • যিনি কারও কাছ থেকে লিখা-পড়া শিখেননি।
  • যিনি সরাসরি আল্লাহর পক্ষ থেকে জ্ঞানপ্রাপ্ত।

কুরআনে আল্লাহ বলেন—

الَّذِينَ يَتَّبِعُونَ الرَّسُولَ النَّبِيَّ الأُمِّيَّ

“যারা অনুসরণ করে সেই রাসূল, উম্মি নবীর…” (সূরা আল-আ’রাফ: ১৫৭)

এখানে নবী ﷺ-এর উম্মি হওয়া তাঁর জন্য একটি মর্যাদার বিষয়, কারণ তিনি মানবীয় শিক্ষার পরিবর্তে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রত্যক্ষভাবে ওহী পেয়েছেন। তাই দরুদে উম্মি নবী ﷺ-এর এই মর্যাদাকে সম্মান করে বলা দরুদ।

দরুদে উম্মির অন্যান্য রূপ

দরুদে উম্মি ছোট হলেও এর কিছু দীর্ঘ রূপও আছে। অনেক আলেম তাদের বইয়ে নিম্নলিখিত বর্ধিত রূপ উল্লেখ করেছেন—

1️⃣ সংক্ষিপ্ত রূপ (সবচেয়ে প্রচলিত):

اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى سَيِّدِنَا مُحَمَّدٍ النَّبِيِّ الأُمِّيِّ وَعَلَى آلِهِ وَسَلِّمْ

2️⃣ বর্ধিত রূপ:

اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى سَيِّدِنَا مُحَمَّدٍ النَّبِيِّ الأُمِّيِّ وَعَلَى آلِهِ وَأَصْحَابِهِ وَسَلِّمْ

(এখানে “আসহাবিহি” যুক্ত হয়েছে, অর্থাৎ সাহাবীদের উপরও সালাম প্রেরণের দোয়া।)

3️⃣ আরও দীর্ঘ রূপ:

اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى سَيِّدِنَا مُحَمَّدٍ النَّبِيِّ الأُمِّيِّ وَعَلَى آلِهِ وَأَزْوَاجِهِ وَذُرِّيَّاتِهِ وَسَلِّمْ

(এখানে নবীর স্ত্রী ও সন্তানদের জন্যও সালাম প্রার্থনা করা হয়েছে।)

👉 তুমি চাইলে ব্লগে তিনটি রূপ আলাদা কার্ড হিসেবে দিতে পারো, যাতে পাঠক যেটি মুখস্থ করতে সহজ মনে করে সেটি নিতে পারে।

দরুদে উম্মির ফজিলতের গল্প/উদাহরণ

দরুদ পাঠের ফজিলত নিয়ে অসংখ্য গল্প ও বর্ণনা পাওয়া যায়। নিচে কিছু অনুপ্রেরণামূলক উদাহরণ—

📖 সাহাবাদের উদাহরণ

আবু হুরাইরা রা. বলেন—

“এক ব্যক্তি নবী ﷺ-কে জিজ্ঞাসা করল, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমি যদি আমার দোয়ার অর্ধেক আপনার উপর দরুদ পাঠে ব্যয় করি?’ তিনি বললেন, ‘এটি তোমার জন্য কল্যাণকর।’ সে বলল, ‘যদি আমি আমার দোয়ার পুরোটা দরুদ পাঠে ব্যয় করি?’
নবী ﷺ বললেন,

تُكْفَى هَمَّكَ وَيُغْفَرُ لَكَ ذَنْبُكَ

“তাহলে তোমার দুশ্চিন্তা দূর করে দেওয়া হবে এবং তোমার গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।”
(তিরমিযি, হাদিস: ২৪৫৭)

এটি প্রমাণ করে দরুদ পড়া বিশেষভাবে দুশ্চিন্তা দূর করার আমল।

আরো পড়ুন:

🕌 আলেমদের অভিজ্ঞতা

ইমাম শাফি (রহ.) বলেছেন—

“আমি যদি কোনো দোয়া কবুল হওয়ার আশা করি, তবে আমি প্রথমে নবী ﷺ-এর উপর দরুদ পাঠ করি, এরপর নিজের প্রয়োজনের কথা বলি। কারণ দরুদ দোয়া কবুল হওয়ার দরজা খুলে দেয়।”

🌸 বাস্তব জীবনের অনুপ্রেরণা

অনেক আলেম ও সাধারণ মানুষ বলেন—

  • যখন তারা কষ্টে থাকে, দরুদে উম্মি বেশি বেশি পড়লে তাদের মন শান্ত হয়।
  • চাকরি বা রিযিকের সমস্যা থাকলে দরুদ পড়ার পর আল্লাহ সহজ রাস্তা করে দেন।
  • অসুস্থ রোগীর পাশে বসে দরুদ পড়লে তার মনে প্রশান্তি আসে।

এগুলো তোমার ব্লগে দিলে পাঠকরা শুধু তথ্যই পাবে না, বরং বাস্তব অনুপ্রেরণা অনুভব করবে।

সাধারণ প্রশ্নোত্তর

❓ ১. দরুদে উম্মি কি কেবল আলেমদের জন্য, নাকি সাধারণ মানুষও পড়তে পারে?

উত্তর: দরুদে উম্মি শুধু আলেমদের জন্য নয়, বরং প্রতিটি মুসলমানের জন্য। এটি একটি ছোট ও সহজ দরুদ, যেটি যেকোনো সময়, যেকোনো স্থানে পড়া যায়। এমনকি যারা নতুন নতুন ইসলাম শিখছেন তারাও সহজে মুখস্থ করতে পারেন।

❓ ২. এটা কি নির্দিষ্ট সংখ্যায় পড়তে হবে?

উত্তর: না, নির্দিষ্ট কোনো সংখ্যা বাধ্যতামূলক নয়। যতবার পড়া যায় ততই ভালো। তবে আলেমরা বলেছেন—

  • প্রতিদিন অন্তত ১০০ বার পড়া উত্তম।
  • শুক্রবারে বেশি পরিমাণে পড়া মুস্তাহাব।
  • দোয়ার আগে ও পরে দরুদ পড়লে দোয়া বেশি কবুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

❓ ৩. দরুদে উম্মি আর দরুদে ইব্রাহিমির মধ্যে পার্থক্য কী?

উত্তর:

  • দরুদে ইব্রাহিমি: নামাজের মধ্যে ফরজ।
  • দরুদে উম্মি: নফল দরুদ, কিন্তু বিশাল ফজিলতপূর্ণ। নামাজের বাইরে বেশি বেশি পড়া যায়।
    অর্থাৎ, দরুদে উম্মি নামাজে পড়া বাধ্যতামূলক নয়, তবে ইচ্ছা করলে নামাজের বাইরে বা জিকিরে পড়া যায়।

❓ ৪. দরুদে উম্মি কি নামাজে পড়া যায়?

উত্তর: হ্যাঁ, পড়া যায়। তবে নামাজের শেষ বৈঠকে দরুদে ইব্রাহিমি পড়া সুন্নত। দরুদে উম্মি অতিরিক্ত পড়লে নামাজে কোনো অসুবিধা নেই।

❓ ৫. এটা পড়লে কি দোয়া বেশি কবুল হয়?

উত্তর: হ্যাঁ। হাদিসে এসেছে—

“যে ব্যক্তি আল্লাহর কাছে কোনো দোয়া করে এবং তার আগে ও পরে আমার উপর দরুদ পড়ে, তার দোয়া আসমান ও জমিনের মাঝখানে আটকে থাকে না (অর্থাৎ সহজে কবুল হয়)।” (তিরমিযি, হাদিস: ৪৮৬)

সুতরাং, দোয়ার শুরুতে ও শেষে দরুদে উম্মি পড়া দোয়া কবুল হওয়ার অন্যতম রহস্য।

❓ ৬. দরুদে উম্মি কি কষ্ট, বিপদ বা অসুস্থতার সময় বিশেষভাবে পড়া যায়?

উত্তর: অবশ্যই। দরুদ পড়া সবসময় বরকতপূর্ণ। বিপদ, দুশ্চিন্তা, অসুস্থতা বা দারিদ্র্যের সময়ে দরুদ পড়া হৃদয়ে প্রশান্তি আনে, আল্লাহর রহমত আহ্বান করে এবং সমস্যা থেকে মুক্তি দেয়।

❓ ৭. এই দুরুদ পড়লে কি গুনাহ মাফ হয়?

উত্তর: হ্যাঁ। সহিহ হাদিসে এসেছে—

“যে ব্যক্তি আমার উপর একবার দরুদ পাঠ করে, আল্লাহ তার দশটি গুনাহ ক্ষমা করে দেন।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৩৮৪)

তাহলে দরুদে উমিম্ পড়লে গুনাহ মাফ হয়, মর্যাদা বৃদ্ধি পায়।

❓ ৮. দরুদে উম্মি বেশি পড়লে কোনো ক্ষতি আছে কি?

উত্তর: না, বরং যত বেশি পড়া যায় ততই ভালো। দরুদে উম্মি আল্লাহর জিকিরের একটি মাধ্যম, তাই এর মধ্যে কোনো ক্ষতির সম্ভাবনা নেই।

❓ ৯. দরুদে উম্মি পড়ার জন্য কোনো বিশেষ শুদ্ধ উচ্চারণ শিখতে হবে কি?

উত্তর: শুদ্ধ উচ্চারণ করা ভালো, তবে দরুদ ভুল উচ্চারণে অর্থ পরিবর্তন না হলে কোনো সমস্যা নেই। ধীরে ধীরে সঠিক তাজবিদ শেখা উত্তম।

❓ ১০. এই দরুদ কি ঘুমানোর আগে পড়া যায়?

উত্তর: হ্যাঁ। ঘুমানোর আগে দরুদে উম্মি পড়া একটি প্রশান্তিময় আমল। এটি হৃদয়কে শান্ত করে এবং ঘুমকে বরকতময় করে।

উপসংহার

দরুদে উম্মি ছোট হলেও এর মাহাত্ম্য বিশাল। প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময় বের করে অন্তত ১০০ বার দরুদে উম্মি পড়ার অভ্যাস করলে দুনিয়া ও আখিরাত উভয় ক্ষেত্রেই উপকার পাওয়া যাবে। নবী ﷺ বলেছেন—

“তোমাদের জন্য আমার উপর দরুদ পড়া তোমাদের দোয়া কবুল হওয়ার অন্যতম কারণ।” (তিরমিযি, হাদিস: ৪৮৬)

সুতরাং, আজ থেকেই এই দরুদকে আমাদের দৈনন্দিন আমলের অংশ বানিয়ে ফেলি।


Share this post
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x