ফরজ গোসলের নিয়ম । সুন্নত পদ্ধতি । মহিলা ও পুরুষের পূর্ণাঙ্গ গাইড

পোস্টটি শেয়ার করুন

ফরজ গোসলের নিয়ম মানার পাশাপাশি, সুন্নত পদ্ধতিতে গোসল করা আরো বেশি পুণ্য লাভের কারণ। গোসলের ফরজ এবং সুন্নত অংশগুলি মেনে চলা একজন মুসলমানকে ইবাদত এবং পার্থিব জীবনে পবিত্রতা ও সফলতা অর্জনে সহায়তা করে। এখন, আসুন ফরজ গোসলের নিয়ম এবং সুন্নত পদ্ধতিগুলি বিস্তারিতভাবে জানি।

ফরজ গোসলের নিয়ম । সুন্নত পদ্ধতি

অনেক হাদিস রয়েছে যা আমাদের ফরজ গোসলের নিয়ম জানতে সাহয্য করে। আমরা নিচে এমন দুটি হাদিস উল্লেখ করছি। অতপর আমরা বিষটি ধাপেধাপে জানব।

প্রথম হাদিস: আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেন,

كان إذا اغتسل من الجنابة: بدأ فغسل يديه، ثم يتوضأ كما يتوضأ للصلاة، ثم يُدخل أصابعه في الماء، فيخلل بها أصول شعره، ثم يصب [وفي رواية: حتى إذا ظن أنه قد أروى بشرته أفاض] على رأسه ثلاث غُرَف بيديه، ثم يفيض الماء على جلده كله

বাংলা অনুবাদ: নবী (সা.) যখন জানাবাতের গোসল করতেন, তখন প্রথমে নিজের দুই হাত ধুয়ে নিতেন। এরপর তিনি সালাতের জন্য যেমন অজু করেন, তেমন অজু করতেন। তারপর তিনি আঙ্গুলের সাহায্যে পানি নিয়ে চুলের গোড়ায় পৌঁছাতেন এবং সেগুলো পরিষ্কার করতেন। এরপর [আরেক বর্ণনায়: যখন তিনি মনে করতেন যে পানি তার ত্বক পর্যন্ত পৌঁছেছে] তিনি নিজের মাথায় তিনবার পানি ঢালতেন। তারপর সমস্ত শরীরে পানি ঢেলে দিতেন।” ( সহিহ বুখারি: ২৪৮)

দ্বিতীয় হাদিস: মাইমুনা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেন,

وضعت للنبي صلى الله عليه وسلم ماءً للغسل [وسترته] فغسل يديه مرتين أو ثلاثًا، ثم أفرغ [بيمينه] على شماله، فغسل مذاكيره (وفي رواية: فرجه وما أصابه من الأذى) ثم دلك يده بالأرض أو بالحائط [ثم غسلها] ثم مضمض واستنشق، وغسل وجهه ويديه وغسل رأسه، ثم صب على جسده ثم تنحى فغسل قدميه، فناولته خرقة فقال بيده هكذا ولم يرُدْها»

বাংলা অনুবাদ:“আমি নবী (সা.)-এর জন্য গোসলের পানি প্রস্তুত করলাম এবং তাঁকে পর্দা দিয়ে ঢেকে দিলাম। তিনি দুই হাত দুইবার বা তিনবার ধুয়ে নিলেন। তারপর ডান হাত দিয়ে বাঁ হাতে পানি ঢেলে নিজের গোপন অঙ্গ পরিষ্কার করলেন [আরেক বর্ণনায়: গোপন অঙ্গ এবং যে অপবিত্রতা লেগেছিল তা পরিষ্কার করলেন]। এরপর তিনি হাত মাটিতে বা দেয়ালে ঘষে পরিষ্কার করলেন [তারপর তা ধুয়ে নিলেন]। এরপর তিনি কুলি করলেন এবং নাকে পানি দিয়ে পরিষ্কার করলেন। তারপর মুখমণ্ডল ও দুই হাত ধুয়ে নিলেন এবং মাথায় পানি ঢাললেন। এরপর সমস্ত শরীরে পানি ঢেলে পরিষ্কার করলেন। শেষে তিনি সরে এসে নিজের পা ধুয়ে নিলেন। আমি তাঁকে একটি কাপড় এগিয়ে দিলে তিনি তা গ্রহণ না করে হাত দিয়ে না-সূচক ইশারা করলেন।” ( সহিহ বুখারি: ২৬৬)

গোসলের সুন্নতসমূহ । ফরজ গোসলের পূর্ণাঙ্গ পদ্ধতি

উপরোক্ত দুটি হাদিস এবং অন্যান্য হাদিস থেকে বোঝা যায় যে, জানাবাতের গোসলের জন্য সুন্নত পদ্ধতি নিম্নরূপ (বড় পবিত্রতা অর্জনের নিয়ত করার পর):

১. নিয়ত করা: গোসল শুরুর আগে পবিত্রতা অর্জনের জন্য মনে মনে নিয়ত করা।

২. দুই হাত ধোয়া: গোসল শুরুর আগে দুই হাত তিনবার ধুয়ে নেওয়া।

৩. গোপন অঙ্গ পরিষ্কার করা: বাঁ হাত দিয়ে গোপন অঙ্গ পরিষ্কার করা এবং যা অপবিত্র লেগেছে তা ধুয়ে ফেলা।

৪. হাত পরিষ্কার করা: গোপন অঙ্গ ধোয়ার পর হাত মাটি বা সাবানের মাধ্যমে পরিষ্কার করা।

৫. অজু করা: গোসলের আগে সালাতের জন্য যেমন অজু করা হয়, তেমন অজু করা।

৬. মাথার চুল পরিষ্কার করা: আঙ্গুল দিয়ে চুলের গোড়ায় পানি পৌঁছানো এবং নিশ্চিত করা যে ত্বক ভিজেছে।

৭. মাথায় পানি ঢালা: মাথায় তিনবার পানি ঢালা।

৮. সারা শরীর ধোয়া: পুরো শরীরে পানি ঢেলে ধুয়ে ফেলা।

৯. পা ধোয়া: গোসল শেষে পা ধুয়ে ফেলা।

গোসলের সময় কুলি করা ও নাকে পানি দেওয়া

অজু ও গোসলের সময় মুখে পানি নিয়ে কুলি করা এবং নাক পরিষ্কার করা (নাকে ভেতর পানি দেওয়া) প্রসঙ্গে চারটি মতামত রয়েছে।

  • ওয়াজিব মত: ইমাম সাওরি, আবু হানিফা, ইমাম আহমদ ও ইবনু মুবারক। তাদের দাবি হলো, মুখ ও নাক পরিষ্কার না করলে গোসল পূর্ণাঙ্গ হয় না।
  • সুন্নম মত: মালিক, শাফেয়ি, লfইস, আওজাই এবং অধিকাংশ আলিমদের মতে গোসলেরসময় কুলি করা ও নাকে পানি দেওয়া সুন্নত।

গোসলের সময় তাঁর দাড়ি খিলাল করা

পন্ডিতদের একটি বড় অংশ, যেমন মালিক, আবু হানিফা, শাফি’ এবং ইবনু হাজারম, তাদের মতে, দাড়ি খিলাল বাধ্যতামূলক নয়, তবে এটি সুন্নত।

বি.দ্র: এই ক্ষেত্রে যদি পানি ত্বকের পর্যন্ত পৌঁছায় তবে চুলকানো জরুরি নয়, তবে যদি পানি ত্বকে পৌঁছাতে না পারে, তাহলে দাড়ি চুলকানো অবশ্যই প্রয়োজন, যাতে পানি ত্বকের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারে।

পায় ধোয়ার সময় কখন?

গোসলের সময় ওজু করা সুন্নত। তবে পা ধোয়ার সময় কখন? ওজু করার সাথেসাথে পা ধোয়া এবং গোসল শেষ করে পা ধোয়া এই দুটি বিষয় হাদিসে এসেছে।

  • সহিহ বুখারির বর্ণনায় এসেছে: ‘যখন তিনি গোসল শেষ করতেন, তখন পা ধুতেন।”
  • তবে আয়েশা (রাঃ)-এর বর্ণিত হাদিসে শুধু উল্লেখ আছে যে, তিনি গোসলের আগে ওজু করতেন।
আলেমদের মতামত

এই দুই হাদিসের ভিত্তিতে আলেমদের চারটি মতামত রয়েছে।

  • পা ধোয়া বিলম্বিত করা: মাইমুনা (রা.)-এর হাদিসের ভিত্তিতে বলা হয়েছে, গোসলের শেষে পা ধোয়া মুস্তাহাব। এটি অধিকাংশ আলেমদের মত।
  • গোসলের আগে পূর্ণ ওজু করা: আয়েশা (রা.)-এর হাদিস থেকে জানা যায়, রাসূলুল্লাহ (সা.) সাধারণত গোসলের আগে ওজু করতেন। এটি শাফি, মালিক (একটি বর্ণনা অনুযায়ী), এবং আহমদের মতে গ্রহণযোগ্য।
  • পা ধোয়ার সময়ের স্বাধীনতা: আহমদ (রহ.)-এর একটি বর্ণনা অনুযায়ী, পা ধোয়ার ক্ষেত্রে পূর্বে বা পরে করার স্বাধীনতা রয়েছে।
  • স্থান অনুযায়ী পা ধোয়া: মালিক (রহ.)-এর মতে, যদি গোসলের স্থান অপরিষ্কার হয়, তাহলে পা ধোয়া শেষে করা উচিত। অন্যথায়, ওজুর সঙ্গে ধোয়া যেতে পারে।

উপসংহার: চতুর্থ মতটি সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়। তবে এ বিষয়ে ব্যাপক সহজতা রয়েছে। আল্লাহ সর্বাধিক জ্ঞানী।

শরীরের অঙ্গগুলো ডলে ধোয়া

আলেমদের মতভেদ রয়েছে যে, গোসলের সময় শরীরের প্রতিটি অঙ্গ হাত দিয়ে ডলে ধোয়া জরুরি কিনা।

  • অধিকাংশের মতামত: শরীরের প্রতিটি অংশে পানি পৌঁছানোই যথেষ্ট। হাত দিয়ে ডলানো মুস্তাহাব।
  • যদি গোসলকারী নিশ্চিত হন যে পানি পুরো শরীরে পৌঁছে গেছে, তাহলে ডলানোর প্রয়োজন নেই।

উপসংহার: শরীরের প্রতিটি অংশ নিশ্চিতভাবে ভেজানোর জন্য ডলানো উত্তম। তবে এটি ফরজ নয়।

পানি ঢালার মাধ্যম

যদি কেউ শাওয়ার বা পানির ধারার নিচে দাঁড়িয়ে পুরো শরীরে পানি পৌঁছাতে সক্ষম হন, তবে সে ক্ষেত্রে তার গোসল সম্পূর্ণ হবে এবং হাতে ডলে বা ঘষে পরিষ্কার করার প্রয়োজন নেই।

আরো পড়ুন:

মহিলাদের গোসলের পদ্ধতি

মহিলাদের জন্য গোসল পুরুষদের মতোই। তবে, যদি তাদের চুল বাঁধা থাকে, অর্থাৎ “প্লেট বা ঝুঁটি” থাকে, তবে চুল খুলে গোসল করার প্রয়োজন নেই। তবে, অবশ্যই চুলের গোড়ায় পানি পৌঁছানো জরুরি।

মাইমুনা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদিসে এসেছে: “আমি চুল শক্ত করে বেঁধে রাখি। গোসলের সময় কি আমি চুল খুলব?” রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘না, তোমার জন্য যথেষ্ট যে তুমি তিনবার মাথায় পানি ঢালবে এবং তারপর তুমি গোসল করবে।'”

মাসিক ও প্রসব-পরবর্তী গোসল

মাসিক বা প্রসব-পরবর্তী গোসলের ক্ষেত্রে সাধারণ গোসলের চেয়ে আরও যত্নবান হওয়া উচিত। বিশেষ করে, সাবান বা অন্যান্য পরিষ্কারক ব্যবহার করার সময় অতিরিক্ত সতর্কতা প্রয়োজন।

আয়েশা (রাঃ)-এর বর্ণনা অনুযায়ী, রাসূলুল্লাহ (সা.) মহিলাদের জন্য পানি ও সিদর (এক প্রকার পরিষ্কারক) ব্যবহার করার পরামর্শ দিয়েছেন।

চুল খুলে ধোয়ার গুরুত্ব: রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন: “মাথার চুল খুলে তা ভালোভাবে ধুয়ে গোড়া পর্যন্ত পানি পৌঁছাও।”

এই হাদিসের মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি যে, মহিলাদের জন্য মাসিক বা প্রসব-পরবর্তী গোসলের ক্ষেত্রে চুল খোলার গুরুত্ব রয়েছে, যাতে গোড়া পর্যন্ত পানি পৌঁছানো নিশ্চিত হয়।

চুল খুলে গোসলের বিষয়ে আলেমদের মতামত

গণমতের মতে, অধিকাংশ আলেম মনে করেন, চুল খোলা মুস্তাহাব (পছন্দনীয়) তবে ফরজ নয়। তাদের যুক্তি হলো, রাসূলুল্লাহ (সা.) শুধুমাত্র মাসিকের ক্ষেত্রে চুল খোলার নির্দেশ দিয়েছিলেন।

তবে, ইমাম আহমদ ও কিছু আলেম মনে করেন, মাসিক বা প্রসব-পরবর্তী গোসলের ক্ষেত্রে চুল খোলা ফরজ। তারা যুক্তি দেন যে, এই সময়ে পবিত্রতার অধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে, তাই চুল খোলার বিষয়টি ফরজ হতে পারে।

মাসিক ও প্রসব-পরবর্তী গোসলের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত বিধান:

১. চুলের গোড়া পর্যন্ত পানি পৌঁছানোর জন্য ভালোভাবে ডলতে হবে। ২. পুরো শরীর ভালোভাবে পরিষ্কার করতে হবে এবং চুল খুলে পানি দিয়ে ধুতে হবে। ৩. এই বিষয়ে সতর্ক থাকা উচিত, কারণ এটি পবিত্রতার এক গুরুত্বপূর্ণ দিক।

উপসংহার: মহিলাদের জন্য মাসিক বা প্রসব-পরবর্তী গোসলের ক্ষেত্রে চুল খোলার বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত, তবে এটি মূলত পবিত্রতার এক গুরুত্বপূর্ণ দিক এবং সাধারণ গোসলের নিয়মের বাইরে কিছুটা


পোস্টটি শেয়ার করুন