আমরা সবাই জানি, নেকি অর্জনের জন্য আল্লাহ অসংখ্য সুযোগ রেখেছেন। কিন্তু যদি এমন একটি দোয়া থাকে, যা একবার পড়লেই বিশ লাখ নেকি পাওয়া যায়—তাহলে কি আমরা তা শিখতে চাইব না? এই দোয়া ইসলামী সূত্রে অত্যন্ত বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর উম্মতকে এমন কিছু আমল শিখিয়েছেন যা সামান্য সময় নেয়, কিন্তু বিপুল পরিমাণ সওয়াব নিয়ে আসে। বিশ লাখ নেকির এই দোয়া ঠিক তেমনই একটি আমল—ছোট অথচ বিশাল ফজিলতের অধিকারী।
এই ব্লগপোস্টে আমরা আলোচনা করব দোয়াটির আরবি, বাংলা উচ্চারণ, অর্থ, হাদিসের প্রমাণ এবং এর ফজিলত। পাশাপাশি শিখব কিভাবে ও কখন এটি পড়া উত্তম, যাতে আমরা সহজেই আমাদের আমলের ঝুলিতে বিশ লাখ নেকি যোগ করতে পারি।
বিশ লাখ নেকির দোয়া: মুসলিমদের জন্য এক মূল্যবান আমল
আমাদের আমলনামা ভারী করার অনেক সহজ উপায় আছে। তার মধ্যে একটি হলো নবী ﷺ কর্তৃক শিক্ষা দেওয়া দোয়া, যা পড়লে আল্লাহ বিশ লাখ (২০,০০,০০০) নেকি দান করেন। এই দোয়া ছোট হলেও এর প্রতিদান বিশাল। মুসলিম জীবনে এমন ছোট ছোট আমল যুক্ত করলে আখিরাতে অসীম উপকার পাওয়া যায়।
দোয়ার আরবি ও বাংলা উচ্চারণ
আরবি:
اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِلْمُسْلِمِينَ وَالْمُسْلِمَاتِ وَالْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ الأَحْيَاءِ مِنْهُمْ وَالأَمْوَاتِ
বাংলা উচ্চারণ: আল্লাহুম্মাগফির লিলমুসলিমীনা ওয়ালমুসলিমাতি ওয়ালমুমিনীনা ওয়ালমুমিনাতি আল-আহইয়াই মিনহুম ওয়ালআমওয়াত।
দোয়ার অর্থ: মনোযোগ সহকারে বোঝা জরুরি
বাংলা অর্থ: “হে আল্লাহ, সব মুসলিম পুরুষ ও নারী, মুমিন পুরুষ ও নারী – জীবিত ও মৃত – সকলকে ক্ষমা করে দিন।”
এ দোয়ায় আমরা গোটা মুসলিম উম্মাহর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছি। এতে নিজের জন্যও ক্ষমা চাওয়া হয়ে যায় এবং সবার জন্য দোয়া করার কারণে আমাদের জন্য আলাদা সওয়াব লেখা হয়।
হাদিসের প্রমাণ ও রেফারেন্স
রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:
مَنْ اسْتَغْفَرَ لِلْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ، كَتَبَ اللَّهُ لَهُ بِكُلِّ مُؤْمِنٍ وَمُؤْمِنَةٍ حَسَنَةً
বাংলা অনুবাদ: “যে ব্যক্তি মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে, আল্লাহ তার জন্য প্রত্যেক মুমিন ও মুমিন নারীর বিনিময়ে একটি করে নেকি লিখে দেন।” [হাদিস: তাবারানি, আল-মুজাম আল-কবীর, হাদিস নং ১০৩৭৫ | সনদ সহিহ]
এই হাদিস অনুযায়ী আমরা যখন এই দোয়া পড়ি, পৃথিবীতে যত মুমিন আছে, তাদের সংখ্যার সমান নেকি আমাদের জন্য লেখা হয়।
ফজিলত: কেন এই দোয়া এত গুরুত্বপূর্ণ
- সবার জন্য দোয়া করার সুযোগ: আমরা শুধু নিজের জন্য নয়, পুরো উম্মাহর জন্য দোয়া করি।
- অগণিত নেকি লাভ: প্রতিটি মুমিনের জন্য আলাদা নেকি লেখা হয়। বিশ্বে কোটি কোটি মুসলিম থাকার কারণে নেকির পরিমাণ বিশাল।
- নিজের জন্যও ক্ষমা: যেহেতু আমরাও মুসলিম/মুমিন, তাই দোয়ায় নিজের জন্যও ক্ষমা চাওয়া হয়ে যায়।
- আল্লাহর রহমত পাওয়ার সহজ আমল: ছোট দোয়া, কিন্তু প্রতিদান আকাশচুম্বী।
কখন ও কিভাবে এই দোয়া পড়বেন
- ফরজ নামাজের পর: প্রতিটি নামাজের পর সংক্ষিপ্ত দোয়ার সময় পড়া উত্তম।
- তাহাজ্জুদ ও একাকী সময়: গভীর মনোযোগ দিয়ে রাতে পড়লে বেশি খুশু হয়।
- কবরস্থানে গেলে: মৃতদের জন্য বিশেষভাবে এই দোয়া করা উত্তম।
- যেকোনো সময়: দিনের বেলায় বা রাতে যে কোনো সময়, এমনকি হেঁটে বা গাড়িতে বসেও পড়া যায়।
পড়ার নিয়ম:
১. নিয়ত করুন আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দোয়া করবেন।
২. আরবি বা বাংলা উচ্চারণে ধীরে ধীরে মনোযোগ সহকারে পড়ুন।
৩. অন্তরে বিশ্বাস রাখুন যে আল্লাহ নিশ্চয়ই কবুল করবেন।
দোয়া পড়ার সময় সাধারণ ভুলগুলো
দোয়া ছোট হওয়ায় অনেকেই গাফিলতিতে পড়েন। সাধারণ কিছু ভুল:
- তাড়াহুড়ো করে পড়া: শব্দ বিকৃত হয়ে যায়, আর মনোযোগ থাকে না।
- অর্থ না বুঝে পড়া: শুধু মুখস্থ করে পড়লে হৃদয়ে প্রভাব কম পড়ে।
- অন্যকে কষ্ট দিয়ে দোয়া পড়া: হিংসা, বিদ্বেষের মাঝে বসে দোয়া করলে ফল কমে যায়।
- শুধু নিজের জন্য ভাবা: মনে হয় আমি পড়লাম, আমারই নেকি হবে – অথচ এই দোয়া গোটা উম্মাহর জন্য।
দোয়ার মাধ্যমে আত্মার পরিশুদ্ধি ও নেকির ভাণ্ডার
এই দোয়া পড়ার মাধ্যমে –
- হৃদয়ের হিংসা ও বিদ্বেষ কমে যায়, কারণ আমরা সবার জন্য ক্ষমা চাই।
- ভ্রাতৃত্বের অনুভূতি জাগ্রত হয়, গোটা উম্মাহর কল্যাণ কামনা করতে শিখি।
- গুনাহ মাফের সম্ভাবনা বাড়ে, কারণ আল্লাহ ক্ষমাশীলদের ভালোবাসেন।
- আমলনামা নেকিতে ভরে যায়, কোটি কোটি মুসলিমের বিনিময়ে নেকি লেখা হয়।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: সাহাবারা কিভাবে করতেন
রাসুলুল্লাহ ﷺ নিজেই তাঁর উম্মাহর জন্য বারবার ক্ষমা প্রার্থনা করতেন। সাহাবারা রাযি. এই সুন্নাহ অনুসরণে খুব যত্নবান ছিলেন।
সাহাবাদের আমল
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন,
“যে ব্যক্তি মুমিন পুরুষ ও নারীদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে, আল্লাহ তার জন্য প্রতিটি মুমিনের সমান নেকি লিখে দেন।” [তাফসির ইবনু কাসির, সূরা হাশর: ১০]
উবাই ইবনে কাব (রাঃ) এবং অনেক সাহাবা তাদের দোয়ার মধ্যে বলতেন:
رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا وَلِإِخْوَانِنَا الَّذِينَ سَبَقُونَا بِالْإِيمَانِ
“হে আমাদের রব, আমাদের এবং আমাদের পূর্ববর্তী ঈমানদার ভাইদের ক্ষমা কর।” [কুরআন, সূরা হাশর: ১০]
সাহাবারা একে অপরকে দোয়া করতে উৎসাহ দিতেন, কারণ তারা জানতেন —
“যখন তুমি তোমার মুসলিম ভাইয়ের জন্য গোপনে দোয়া করো, ফেরেশতা বলে: ‘তোমার জন্যও একই দোয়া কবুল হোক।’” [সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৭৩২]
তাদের শিক্ষা আমাদের জন্য:
সাহাবারা শুধু নিজেদের নয়, সব মুসলিমদের জন্য দোয়া করতেন। তারা বুঝতেন, উম্মাহর জন্য দোয়া করা মানে নিজের জন্যও দোয়া করা। তাই এই দোয়া শুধু মুখস্থ আমল নয়, বরং এক গভীর ভ্রাতৃত্বের প্রকাশ।
ইমোশনাল ছোট গল্প: উম্মাহর জন্য রাতভর দোয়া
এক সাহাবী (রাযি.) প্রতিদিন রাতে তাহাজ্জুদের সময় আল্লাহর কাছে দীর্ঘ সময় ধরে দোয়া করতেন। একদিন তাঁর স্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন,
“আপনি কি প্রতিরাতে শুধু নিজের জন্য দোয়া করেন?”
তিনি হাসিমুখে উত্তর দিলেন,
“না, আমি প্রথমেই আমার ভাই-বোনদের জন্য দোয়া করি। কারণ আমি জানি, ফেরেশতা আমার জন্যও একই দোয়া করে।”
এরপর তিনি সূরা হাশরের এই দোয়া পাঠ করলেন:
رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا وَلِإِخْوَانِنَا الَّذِينَ سَبَقُونَا بِالْإِيمَانِ
“হে আমাদের রব! আমাদের এবং আমাদের পূর্ববর্তী ঈমানদার ভাইদের ক্ষমা কর।”
এই ঘটনা আমাদের শেখায় — নিজের দোয়ার শুরুটা অন্যদের জন্য করলে, আল্লাহ আমাদের দোয়াও কবুল করেন এবং ফেরেশতারা আমাদের জন্য একই কল্যাণ কামনা করেন।
সাধারণ প্রশ্নোত্তর
প্রশ্ন ১: দিনে কয়বার এই দোয়া পড়া উত্তম?
উত্তর: নির্দিষ্ট সংখ্যা নেই। তবে প্রতিদিনের নামাজের পর অন্তত একবার পড়া খুবই উত্তম।
প্রশ্ন ২: আরবি না জানলে কি বাংলা উচ্চারণে পড়া যাবে?
উত্তর: হ্যাঁ, বাংলা উচ্চারণে পড়া যাবে। তবে চেষ্টা করুন ধীরে ধীরে আরবি শিখে সঠিকভাবে উচ্চারণ করতে।
প্রশ্ন ৩: অন্যদের জন্য দোয়া করলে নিজের দোয়া কি কবুল হয়?
উত্তর: হ্যাঁ, সহিহ হাদিসে এসেছে — যখন কেউ তার ভাইয়ের জন্য গোপনে দোয়া করে, ফেরেশতা বলে, “তোমার জন্যও একই দোয়া কবুল হোক।”
প্রশ্ন ৪: এই দোয়া পড়লে কি মৃতদের জন্যও সওয়াব হয়?
উত্তর: অবশ্যই। দোয়ায় জীবিত ও মৃত সকল মুমিনের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা আছে। তাই এটি মৃতদের জন্যও সওয়াব পৌঁছে দেয়।
সমাপনী কথা: আমলে স্থায়িত্ব আনার জন্য করণীয়
- প্রতিদিনের রুটিনে দোয়া যুক্ত করুন, যেমন নামাজের পর বা ঘুমানোর আগে।
- পরিবারকে শিখিয়ে দিন, যাতে সম্মিলিতভাবে সবাই দোয়া করতে পারে।
- মাঝে মাঝে অর্থ পড়ে ভাবুন, এতে মনোযোগ বাড়বে।
- নিজেকে মনে করিয়ে দিন – “আমি আজ কয়টি মানুষের জন্য দোয়া করলাম?” এতে নিয়মিততা আসবে।