দরুদে তুনাজ্জিনা (Salat al-Tunjina) হলো একটি জনপ্রিয় দুরুদ শরীফ, যা বিশেষ করে বিপদ, দুঃখ-কষ্ট ও বিপর্যয় থেকে মুক্তির আশায় পাঠ করা হয়। মুসলিম বিশ্বের অনেক স্থানে এটি ব্যাপকভাবে প্রচলিত। তবে, এর উৎপত্তি, বৈধতা এবং ফজিলত নিয়ে আলেমদের মধ্যে ভিন্নমত রয়েছে। এই ব্লগপোস্টে আমরা দরুদে তুনাজ্জিনা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব।
দরদে তুনাজ্জিনা কী?
“দরুদে তুনাজ্জিনা” শব্দের অর্থ হলো – মুক্তি দানকারী দরুদ। প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী, এই দরুদ পাঠ করলে:
- বিপদ-আপদ দূর হয়
- রোগ-বালাই থেকে মুক্তি মেলে
- দুঃখ-দুর্দশা দূর হয়
- দোয়া কবুল হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়
এটি সাধারণত বিশেষ সংখ্যায় পড়া হয়, যেমন ৪৪৪৪ বার, অথবা বিপদের সময় খতম আকারে পাঠ করা হয়।
দরুদে তুনাজ্জিনা আরবি পাঠ
اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى سَيِّدِنَا مُحَمَّدٍ صَلَاةً تُنَجِّينَا بِهَا مِنْ جَمِيعِ الْأَهْوَالِ وَالْآفَاتِ، وَتَقْضِي لَنَا بِهَا جَمِيعَ الْحَاجَاتِ، وَتُطَهِّرُنَا بِهَا مِنْ جَمِيعِ السَّيِّئَاتِ، وَتَرْفَعُنَا بِهَا عِنْدَكَ أَعْلَى الدَّرَجَاتِ، وَتُبَلِّغُنَا بِهَا أَقْصَى الْغَايَاتِ مِنْ جَمِيعِ الْخَيْرَاتِ فِي الْحَيَاةِ وَبَعْدَ الْمَمَاتِ، إِنَّهُ سَمِيعٌ قَرِيبٌ مُجِيبُ الدَّعَوَاتِ
বাংলা উচ্চারণ : “আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা সাইয়্যিদিনা মুহাম্মাদিন সালাতান তুনাজ্জিনা বিহা মিন জামিইল আহওয়ালি ওয়াল-আফাতি, ওয়া তাকদ্বি লানা বিহা জামিআল হাজ্জাতি, ওয়া তুতাহহিরুনা বিহা মিন জামিইস সাইয়্যিয়াতি, ওয়া তারফাউনাবিহা ইন্দাকা আ‘লা দারাজাতি, ওয়া তুবাল্লিগুনা বিহা আকসাল গায়াতি মিন জামিইল খইরাতি ফিল হায়াতি ওয়া বা‘দাল মামাতি, ইন্নাহু সামি‘উন কারিবুন মুজীবুদ দা‘ওয়াতি.”
দরুদে তুনাজ্জিনা বাংলা অর্থ
“হে আল্লাহ, আমাদের প্রিয়নবী মুহাম্মদ ﷺ এর উপর এমন রহমত বর্ষণ করুন, যার মাধ্যমে আপনি আমাদের সকল ভয় ও বিপদ থেকে মুক্ত করবেন, আমাদের সব প্রয়োজন পূর্ণ করবেন, আমাদেরকে সকল গুনাহ থেকে পাক-সাফ করবেন, আমাদের মর্যাদা উঁচু করবেন, এবং আমাদেরকে দুনিয়া ও আখিরাতের সব ভালো জিনিস দান করবেন। নিশ্চয়ই আপনি দোয়া কবুলকারী, নিকটবর্তী ও শ্রবণকারী।”

ইতিহাস ও উৎপত্তি
দরুদে তুনাজ্জিনা কুরআন বা সহিহ হাদীসে নেই। এটি পরবর্তীকালে মুসলিম সমাজে রচিত ও প্রচলিত হয়। ধারণা করা হয়, কোনো আউলিয়া বা পরবর্তী যুগের কোনো আলেম বিশেষ প্রেক্ষাপটে এটি রচনা করেন। তবে এর প্রামাণ্যতা নিয়ে নির্ভরযোগ্য উৎস নেই।
দরুদে তুনাজ্জিনা পড়ার নিয়ম
- অনেকে মনে করেন, বিপদের সময় এই দরুদ ৪৪৪৪ বার পড়তে হয়।
- কেউ কেউ মনে করেন, প্রতিদিন নির্দিষ্ট সংখ্যায় (যেমন ১১ বার বা ১০০ বার) পড়লে উপকার পাওয়া যায়।
- তবে শরীয়তে এই নির্দিষ্ট সংখ্যার কোনো ভিত্তি নেই।
আলেমদের মতামত
- সমর্থনকারী আলেমগণ
- তারা বলেন, এটি একটি দোয়া মাত্র। আল্লাহর কাছে নবীর মাধ্যমে রহমত প্রার্থনা করা বৈধ। তাই কেউ চাইলে সাধারণ দোয়া হিসেবে পড়তে পারেন।
- বিরোধী আলেমগণ
- তাদের মতে, যেহেতু এটি সহিহ সূত্রে প্রমাণিত নয়, তাই এটিকে বিশেষ ফজিলতযুক্ত মনে করা বিদআত।
- নির্দিষ্ট সংখ্যায় পড়া, বিশেষ ফল পাওয়া যাবে বলে বিশ্বাস করা শরীয়তের অংশ নয়।
কুরআন ও হাদীসের আলোকে বিশ্লেষণ
- কুরআনে দুরুদের আদেশ
- আল্লাহ বলেন:
“নিশ্চয়ই আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতারা নবীর প্রতি দুরুদ পাঠ করেন। হে ঈমানদারগণ! তোমরাও তাঁর উপর দুরুদ ও সালাম পাঠ কর।” (সূরা আহযাব: ৫৬)
- আল্লাহ বলেন:
- সহিহ দুরুদ (দরুদে ইবরাহিমী)
- রাসূল ﷺ সাহাবিদের দুরুদে ইবরাহিমী শিখিয়েছেন, যা সালাতে তাশাহহুদের পর পড়া হয়।
- এর বাইরে কোনো বিশেষ দরুদ নির্দিষ্ট ফজিলতসহ প্রমাণিত নয়।
ভুল ধারণা ও বাস্তবতা
ভুল ধারণা:
- দরুদে তুনাজ্জিনা ৪৪৪৪ বার না পড়লে বিপদ যাবে না।
- এটি ছাড়া অন্য দরুদে মুক্তি নেই।
বাস্তবতা:
- আল্লাহ যেকোনো দোয়া কবুল করতে সক্ষম।
- দুরুদে ইবরাহিমী হলো সহিহ ও প্রমাণিত দরুদ।
- দরুদে তুনাজ্জিনা সাধারণ দোয়া হিসেবে পড়া যেতে পারে, তবে নির্দিষ্ট সংখ্যার শর্ত আরোপ করা বিদআত।
প্রায়োগিক পরামর্শ
- সহিহ দুরুদে অগ্রাধিকার দিন – দুরুদে ইবরাহিমী বেশি বেশি পড়ুন।
- কুসংস্কার থেকে বাঁচুন – নির্দিষ্ট সংখ্যা বা খতম আকারে বাধ্যতামূলকভাবে পড়া থেকে বিরত থাকুন।
- আল্লাহর কাছে সরাসরি দোয়া করুন – সব বিপদ-আপদ থেকে মুক্তি কেবল আল্লাহর কাছেই আসে।
- অন্যকে বাধ্য করবেন না – কেউ পড়লে তাকে বিদআতকারী বলা ঠিক নয়, তবে বিশেষ ফজিলতযুক্ত হিসেবে প্রচার করাও উচিত নয়।
সারাংশ
দরুদে তুনাজ্জিনা মুসলিম সমাজে একটি প্রচলিত দরুদ, যা বিপদ ও দুঃখ থেকে মুক্তির আশায় পড়া হয়। তবে এটি কুরআন ও সহিহ হাদীসে প্রমাণিত নয়। তাই বিশেষ ফজিলতযুক্ত বা নির্দিষ্ট সংখ্যায় পড়াকে শরীয়তের অংশ মনে করা বিদআত হতে পারে। একজন মুসলিমের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ হলো – কুরআন ও সহিহ হাদীসের দলিল অনুসরণ করা, এবং সহিহ দরুদ যেমন দুরুদে ইবরাহিমী বেশি বেশি পাঠ করা।
ইসলামিক ফিকহি দৃষ্টিকোণ
দরুদে তুনাজ্জিনা নিয়ে আলেমদের মধ্যে বিভিন্ন মতামত পাওয়া যায়। বিষয়টি মূলত চারটি আলোচনায় বিভক্ত করা যায়:
১. কুরআন ও হাদীসে প্রমাণ
- কুরআনে দুরুদ পাঠের নির্দেশ এসেছে (সূরা আহযাব: ৫৬)।
- সহিহ হাদীসে নবী ﷺ সাহাবিদের দুরুদে ইবরাহিমী শিক্ষা দিয়েছেন (সহিহ বুখারী, সহিহ মুসলিম)।
- তবে দরুদে তুনাজ্জিনা কোনো সহিহ হাদীস থেকে প্রমাণিত নয়। অর্থাৎ এটি সরাসরি রাসূল ﷺ বা সাহাবাদের আমল নয়।
২. বিদআতের শঙ্কা
- ইসলামি শরীয়তে ইবাদতগুলো নির্দিষ্ট। কোনো নতুন পদ্ধতি বা নির্দিষ্ট সংখ্যা যুক্ত করা হলে সেটি বিদআত হয়ে যায়।
- যেমন—৪৪৪৪ বার বা নির্দিষ্ট সময়ে পড়া, অথবা একে “সব বিপদ থেকে মুক্তির গ্যারান্টিযুক্ত দুরুদ” বলা – এগুলো বিদআত।
- হাদীসে রাসূল ﷺ বলেছেন: “যে ব্যক্তি আমাদের এই ধর্মে এমন কিছু নতুন সৃষ্টি করল, যা এর অন্তর্ভুক্ত নয়, তা প্রত্যাখ্যাত।” (সহিহ বুখারী, সহিহ মুসলিম)
৩. সাধারণ দোয়া হিসেবে বৈধতা
- দরুদে তুনাজ্জিনার আরবি টেক্সটে আল্লাহর কাছে দোয়া করা হয়েছে এবং নবীর ﷺ উপর দুরুদ প্রেরণ করা হয়েছে। এতে কোনো শিরক, কুফরি বা অনৈসলামিক কথা নেই।
- তাই সাধারণ মুনাজাত বা দোয়ার মতো পড়া যায়।
- কিন্তু এটিকে নির্দিষ্ট ফজিলতসহ বাধ্যতামূলক মনে করা যাবে না।
৪. আলেমদের মতামত
- শাফেয়ী ও হানাফি মাজহাবের অনেক আলেম বলেছেন: যদি কেউ এটি সাধারণ দোয়া মনে করে পড়ে, তাহলে জায়েয।
- সালাফি ও আহলে হাদীস আলেমরা বলেন: এটি সহিহ হাদীসে নেই, তাই নির্দিষ্ট ফজিলতসহ আমল করা বিদআত।
- সুফি তরিকতের অনুসারীরা বলেন: এটি অভিজ্ঞতার মাধ্যমে ফজিলতপূর্ণ, তবে শরীয়তের প্রমাণ দিয়ে নয়।
৫. মূল শিক্ষা
- দুরুদ পাঠ করা ইবাদত। তবে কোন দুরুদ পড়তে হবে তা রাসূল ﷺ নির্ধারণ করে দিয়েছেন।
- সহিহ দুরুদ (বিশেষত দুরুদে ইবরাহিমী) হলো মুসলিম উম্মাহর জন্য সবচেয়ে উত্তম।
- দরুদে তুনাজ্জিনা পড়লে দোয়া হিসেবে কবুল হতে পারে, তবে এটিকে শরীয়ত-প্রমাণিত বা বিশেষ ফজিলতপূর্ণ বলে প্রচার করা সঠিক নয়।
👉 সারসংক্ষেপ: দরুদে তুনাজ্জিনা সাধারণ দোয়া হিসেবে পড়া যাবে, তবে নির্দিষ্ট ফজিলত বা সংখ্যাসহ প্রচার করা বিদআত। মুসলমানদের উচিত সহিহ হাদীসে প্রমাণিত দুরুদকে অগ্রাধিকার দেওয়া, বিশেষত দুরুদে ইবরাহিমীকে।
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী
১. দরুদে তুনাজ্জিনা কী?
দরুদে তুনাজ্জিনা হলো একটি জনপ্রিয় দোয়া, যা অনেক মুসলিম বিপদ, দুঃখ-কষ্ট ও সমস্যা থেকে মুক্তির আশায় পড়ে থাকেন। এর আরবি টেক্সট দীর্ঘ এবং এতে আল্লাহর কাছে নবী ﷺ এর মাধ্যমে মুক্তি, সাহায্য, ক্ষমা, উন্নতি এবং কল্যাণ চাওয়া হয়েছে। তবে এটি কোনো সহিহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়। এজন্য এটি দুরুদে ইবরাহিমীর মতো শরীয়তে বাধ্যতামূলক বা নির্ধারিত দুরুদ নয়।
২. দরুদে তুনাজ্জিনা কোথা থেকে এসেছে?
দরুদে তুনাজ্জিনা সরাসরি কুরআন বা সহিহ হাদীস থেকে আসেনি। ঐতিহাসিকভাবে জানা যায়, উত্তর আফ্রিকার (তিউনিশিয়া বা মরক্কো অঞ্চলের) কিছু সুফি আলেম এটি প্রচলন করেন। বলা হয়, সমুদ্রযাত্রার সময় ঝড়ে পড়ে নিরাপদে তীরে পৌঁছাতে তারা এই দুরুদ পাঠ করেন, এবং পরবর্তীতে মানুষ এটিকে “বিপদ থেকে মুক্তির বিশেষ দুরুদ” হিসেবে জনপ্রিয় করে তোলে। তবে ইসলামিক শরীয়তের দৃষ্টিতে এটি মানুষের বানানো দোয়া, নবী ﷺ বা সাহাবাদের আমল নয়।
৩. নির্দিষ্ট সংখ্যায় (যেমন ৪৪৪৪ বার) পড়া কি বৈধ?
না, নির্দিষ্ট সংখ্যা পড়া শরীয়তে প্রমাণিত নয়। কুরআন-হাদীসে দুরুদ পাঠের সাধারণ ফজিলত আছে, কিন্তু “অমুক দুরুদ এতবার পড়লে অমুক সমস্যার সমাধান হবে” – এমন নির্দিষ্ট সংখ্যা ও ফলাফলের কোনো ভিত্তি নেই।
- দুরুদ যেকোনো পরিমাণে পড়া যাবে।
- তবে সংখ্যার সাথে বিশেষ ফজিলত জুড়ে দেওয়া হলে সেটি বিদআত হিসেবে গণ্য হবে।
৪. দরুদে তুনাজ্জিনা পড়া কি বিদআত?
👉 দুটি দিক আছে:
- সাধারণ দোয়া হিসেবে: আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতে চাইলে পড়া যায়, কারণ এর মধ্যে শিরক বা কুফরি কিছু নেই। এটি সাধারণ মুনাজাতের মতো হবে।
- বিশেষ ফজিলতসহ বা নির্দিষ্ট আমল হিসেবে: এটিকে “অবশ্যই পড়তে হবে”, বা “এতবার পড়লেই মুক্তি নিশ্চিত” – এভাবে মনে করলে তা বিদআত। কারণ ইসলামি শরীয়তে এর প্রমাণ নেই এবং রাসূল ﷺ বা সাহাবায়ে কেরাম এভাবে দুরুদ পড়েননি।
৫. মুসলমানদের জন্য সবচেয়ে উত্তম দরুদ কোনটি?
সবচেয়ে উত্তম ও প্রমাণিত দুরুদ হলো দুরুদে ইবরাহিমী, যা হাদীসে স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে।
রাসূল ﷺ যখন সাহাবাদের শিক্ষা দিয়েছিলেন কিভাবে তাঁর ওপর দুরুদ পাঠ করতে হয়, তখন তিনি এই দুরুদ শেখান (সহিহ বুখারী, সহিহ মুসলিম):
আরবি:
اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا صَلَّيْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ وَعَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ، اللَّهُمَّ بَارِك عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا بَارَكْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ وَعَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ
বাংলা অর্থ: হে আল্লাহ, মুহাম্মদ ও তাঁর পরিবার-পরিজনের উপর রহমত বর্ষণ করুন যেমন আপনি ইবরাহিম ও তাঁর পরিবার-পরিজনের উপর রহমত বর্ষণ করেছেন। নিশ্চয়ই আপনি মহাপ্রশংসিত, মহান মহিমাময়। হে আল্লাহ! মুহাম্মদ ও তাঁর পরিবার-পরিজনকে বরকত দান করুন যেমন আপনি ইবরাহিম ও তাঁর পরিবার-পরিজনকে বরকত দান করেছেন। নিশ্চয়ই আপনি মহাপ্রশংসিত, মহান মহিমাময়।
➡️ এ দুরুদই সালাতের মধ্যে তাশাহহুদের পরে পড়া ফরজ এবং মুসলমানদের জন্য সবচেয়ে উত্তম দুরুদ।
আরো পড়ুন :