সুন্দর এই পৃথিবীতে আগম ও শিশু থেকে বড় হয়ে আজকের এই সময়ে আসার সকল কৃতিত্ব মা ও বাবার। তাই আমরা চিরদিনের জন্য মা ও বাবার কাছে ঋণী। ছোট্র এই জীবনে তাদের এ ঋণ পরিশোধ আমাদের পক্ষে মোটেও সম্ভব নয়। আমরা কেবল তাদের কৃতজ্ঞতা আদায় করতে পারি জীবনভর। তাদের কৃতজ্ঞতা আদায়ের উত্তম একটি উপায় হল তাদের জন্য দোয়া করা। রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বায়ানি সাগিরা, এই দোয়াটি এক্ষেত্রে অনন্য।
এই দোয়াটির আরবি উচ্চারণ, অর্থ ও তাৎপর্য সম্পর্কে বিস্তারিত আমরা এখানে আলোচনা করছি। সেই সাথে হাদিস অনুযায়ী এটির ব্যাখ্যা ও ইমামগণের উদ্ধৃতি তুলে ধরব। আশা করি এটা আপনাকে পরিপূর্ণ জ্ঞানের সাথে জীবনভর দোয়াটি করতে উৎসাহ দিবে।
রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বায়ানি সাগিরা। আরবি ও অর্থ
মাতা পিতার জন্য দোয়ার মূল আরবি হল –
رَّبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرًا
উচ্চারণ: রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বায়ানি সাগিরা।
অর্থ: হে আমার প্রতিপালক, আপনি তাদের ( মাতা ও পিতার) প্রতি রহম ( দয়া) করুন, যে রকম তারা আমাকে শিশুকালে ( মায়া-মমতা ও স্নেহপরায়ণ আচরণ দ্বারা) লালনপালন করেছেন।
দোয়াটির উৎস
এই দোয়াটির ব্যাখ্যা বুঝতে হলে পূর্ববর্তী আয়াত থেকে বুঝা দরকার। পূর্বের আয়াত হল –
وَقَضَىٰ رَبُّكَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا ۚ إِمَّا يَبْلُغَنَّ عِندَكَ الْكِبَرَ أَحَدُهُمَا أَوْ كِلَاهُمَا فَلَا تَقُل لَّهُمَا أُفٍّ وَلَا تَنْهَرْهُمَا وَقُل لَّهُمَا قَوْلًا كَرِيمًا
অর্থ : আর তোমার রব আদেশ দিয়েছেন যে, তোমরা কেবল তাঁর ইবাদত করবে এবং পিতা-মাতার সাথে সদাচরণ করবে। তাদের কোনো একজন অথবা উভয়জন যদি তোমার নিকট বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদেরকে কষ্টদায়ক কথা বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না। আর তাদের সাথে সম্মানজনক কথা বল। (সুরা বনি ইসরাইল :২৩)
এই আয়াতে আল্লাহ তায়ালা পিতা মাতার প্রতি আমাদের আচরণ কেমন হওয়া উচিত তা শিক্ষা দিয়েছেন। পরের আয়াতে বলেন:
وَاخْفِضْ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحْمَةِ وَقُل رَّبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرًا
[ الإسراء: 24]
অর্থ: আর তাদের জন্য দয়াপরশ হয়ে বিনয়ের ডানা নত করে দাও এবং বল, হে আমার প্রতিপালক, আপনি তাদের ( মাতা ও পিতার) প্রতি রহম ( দয়া ) করুন, যে রকম তারা আমাকে শিশুকালে ( মায়া-মমতা ও স্নেহপরায়ণ আচরণ দ্বারা) লালনপালন করেছেন। (সুরা বনি ইসরাইল :২৪)
দোয়াটির ব্যাখ্যা
আল্লাহ তায়ালা এই দুটি আয়াতে সমাজের সকল শ্রেণির মানুষকে নির্দেশ করে বলেন, হে সমাজে সম্মানিত ব্যক্তি, জ্ঞানের অধিকারী, অঢেল সম্পদশালী, হে সমাজের লোকসকল তুমি তোমার পিতা মাতার প্রতি বিনয় প্রদর্শন করো। তুমি তোমার পিতার মাতার সামনে সর্বোচ্চ আদব বজায় রাখো – তোমার কথা, তোমার কাজ, তোমার আচার আচরণ ও পদক্ষেপে, তুমি তো কেবল তাদের রূপিত বৃক্ষ ছাড়া কিছুই নও।
তাফসিরবিদ আলুসি বলেন
وقل في الدعاء لهما: يا رب ارحمهما برحمتك الواسعة، واشملهما بمغفرتك الغامرة،جزاء ما بذلا من رعاية لي في صغرى، فأنت القادر على مثوبتهما ومكافأتهما
অর্থ: আর তুমি তাদের জন্য দোয়ায় বল, হে আমার রব, আপনি আপনার প্রসস্থ দয়ায় তাদের আবৃত করে নিন। তাদেরকে আপনার বিস্তৃত ক্ষমায় ঢেকে নিন। তারা আমার শিশুকালে প্রতিপালনে যে পরিশ্রম করেছেন তার প্রতিদান হিসাবে। কেননা আপনি প্রতিদান ও বদলা দিতে সক্ষম।
তাৎপর্য
ইসলামে, পিতামাতাকে সম্মান ও তাদের আনুগত্য করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি একজন মুসলিমের মৌলিক কর্তব্যগুলির মধ্যে একটি। আমরা আমাদের পিতামাতার প্রতি করুণা প্রার্থনার এই দোয়াটি আমাদেরকে আমাদের শিশুকালের কথা মনে করিয়ে দেয়। যখন আমরা অবোধ ছিলাম তখন তারা আমাদের লালন-পালনের সময় তাদের ত্যাগ, ভালবাসা এবং যত্নকে আমাদরে সামনে উপস্থাপন করে। এটি সন্তানদের লালন-পালন ও সার্বিক ক্ষেত্রে পিতামাতার প্রচেষ্টার জন্য কৃতজ্ঞতার ঋণ স্বীকার করাকে প্রতিফলিত করে।
এই প্রার্থনাটি পিতামাতার প্রতি দয়া, সম্মান এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশের উপায়। এটি পারিবারিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে করুণা ও সমবেদনার মূল্যকে জোর দেয়। সেই সাথে আল্লাহ তায়ালার আদেশ পালনের ক্ষেত্রে আমাদের অনুপ্রেরণা যোগায়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
الوالد أوسط أبواب الجنة فحافظ إن شئت أو ضيع
পিতা জান্নাতের মধ্যবর্তী দরজা, তোমার ইচ্ছা হলে এ দরজাকে সংরক্ষণ কর অথবা নষ্ট কর। ( তিরমিজি : ১৯০০)
কয়েকটি প্রশ্ন উত্তর
পিতা মাতা কাফির হলে তাদের জন্য দোয়া করা যাবে কি?
হ্যা, পিতা মাতা কাফির হলে তাদের জন্য হেদায়াতের দোয়া করা যাবে। আর তারা যদি কাফির অবস্থায় মৃত্যবরণ করেন তাহলে তাদের জন্য আর দোয়া করার সুযোগ নেই। ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহ আনহু বলেন,
هذا منسوخ بقوله : ” ما كان للنبي والذين آمنوا أن يستغفروا للمشركين ” ( التوبة – 13 )
অনুবাদ: এটা ( কাফির পিতামাতার জন্য দোয়া করাটা ) আল্লাহ তায়ালার এই আয়াত দ্বারা রহিত হয়ে গেছে: ’ নবি ও মুমিনদের পক্ষে শোভনীয় নয় যে তারা মুশরিকদের জন্য ইসতেগফার করবে। ( সুরা তাওবা, আয়াত : ১৩)
পিতামাতার অবাধ্য হওয়া কেমন পাপ?
পিতামতার অবাধ্য হওয়া কবিরা গোনাহ। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
رضا الله في رضا الوالدين، وسخط الله في سخط الوالدين
অনুবাদ: আল্লাহ সন্তুষ্টি পিতামাতার সন্তুষ্টির মধ্যে নিহিত। আর আল্লাহর অসন্তুষ্টি পিতামাতার অসন্তুষ্টির মধ্যে নিহিত। ( তিরিমিযি : ১৮৯৯)
ভালো উদ্দেশ্যে পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া যাবে কি?
পিতামাতা কুরআন ও সুন্নাহ বিরোধী কোন আদেশ দিলে সেটা মানা যাবে না। কিন্তু তাদের সঙ্গে সর্বদা সদ্ব্যবহার বজায় রাখতে হবে। পিতা-মাতা ও সন্তান উভয়কে মনে রাখতে হবে যে, ‘স্রষ্টার অবাধ্যতায় সৃষ্টির প্রতি কোন আনুগত্য নেই’। তাছাড়া আপনার ভালো উদ্দেশ্য কী সেটা কীভাবে ভালো বলে নিশ্চিত হবেন এ নিয়ে মতভেদ থাকবে পারে।