কোন নবীর গায়ে পোকা হয়েছিল? রেফারেন্সসহ বিস্তারিত বিশ্লেষণ

শেয়ার করুন

কোন নবীর গায়ে পোকা হয়েছিল? এই প্রশ্নটির সঠিক উত্তর হল কোনো নবীর গায়ে পোকা হয়নি। আইয়ুব আলাইহিস সালামের গায়ে পোকা হয়েছিল বলে অনেকে বলে থাকেন। কিন্তু কুরআন ও হাদিসে সে সম্পর্কে গ্রহণযোগ্য কোনো তথ্য পাইনি। পবিত্র কুরআন থেকে আমরা কেবল জানতে পারি আল্লাহ তায়াল তাঁর এই প্রিয় বান্দাকে কঠিন ও জটিল রোগ দ্বারা পরিক্ষা করেছিলেন। কিন্তু সেই রোগ কী ছিল সে সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞান আমাদের কাছে নেই।

তাই আইয়ুব আলাইহিস সালামের গায়ে পোকা হয়েছিল, এ কথা আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারব না। তাঁর গায়ে কোন ধরণের রোগ হয়েছিল সেটা নিয়ে মুফ্ফাসিরিনে কেমার বিভিন্ন মতামত দিয়েছেন। একটি হাদিসে আকাশ থেকে নেমে আসা সোনার পোকা সংক্রান্ত একটি ঘটনা আইয়ুব আলাইহিস সালামের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছে। এখান থেকে অনেকে ভুল বুঝে থাকেন। তাই আইয়ুব আলাইহিস সালামের রোগ ও তার সাথে সংশ্লিষ্ট সোনার পোকার ঘটনা নিয়ে এখানে আমরা আলোচনা করছি। এটা আপনাকে পুরো বিষয়টি বুঝতে ও ভুল ধারণা দূর করতে সাহায্য করবে।

কেন কোন নবীর গায়ে পোকা হয়েছিল বলা যাবে না?

কোন একজন নবীর গায়ে পোকা হয়েছিল এ কথা বলটা আল্লাহর নবীর সাথে বেয়াদবি। আল্লাহ তায়াল তাঁর নবীদের মহৎ চরিত্র, উত্তম গুণাবলি, শারীরিক ও মানসিক উৎকর্ষ দিয়ে প্রেরণ করেছিলেন। তাদেরকে সমাজের আদর্শ ও অনুসরণীয় ব্যক্তি হিসাবে প্রেরণ করেছিলেন। কিন্তু কোনো নবীর গায়ে যদি পোকা থাকে তাহলে সমাজরে মানুষ তাকে অনুসরণ তো বহু দূরের কথা সবাই তাকে ঘৃণা করবে। ইয়াযু বিল্লাহ। এটা আল্লাহর নবীদের নবুওয়্যাতি পরপন্থি। তাই আমরা কোন নবীর গায়ে পোকা হয়েছিল এ কথা বলা থেকে বিরত থাকব।

এই বিষয়ে বিস্তারিত জানতে আমাদের ভিডিওটি দেখুন।

ইভিডেন্স

রাসুলুুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

 « مَا بَعَثَ الله نَبِيًّا إِلاَّ حَسَنَ الْوَجْهِ حَسَنَ الصَّوْتِ وَإِنَّ نَبِيَّكُم أَحسَنُهُمْ وَجْهًا وَأَحْسَنُهُمْ صَوْتًا » رواه التِّرميذي فالأنبياء ﻻ تصيبهم اﻷمراض المنفِّرَةُ كالبَرَصِ و خُروج الدُّودِ، فغير صحيح أنّ سيِّدنا أيُّوب خرج منه الدُّود وغير صحيح أنّه كان يأخذ الدُّود ويقول كلي ممّا رزقك اللّه ، فمن قال ذلك فقد كذّب الدِّين.

অনুবাদ: আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক নবীকে সুন্দর চেহারা ও সুললিত কণ্ঠ দিয়ে প্রেরণ করেছেন। আর তোমাদের নবী তাদের সকলের চেয়ে সুন্দর চেহারা ও কণ্ঠের অধিকারী। ( তিরিমিযি)

কাজেই কোনো নবীকে মানুষ ঘৃণা করে এমন কোনো রোগ আক্রান্ত করেনি, যেমন কুষ্ঠ রোগ, পোকা বের হওয়া ইত্যাদি। তাই আইয়ুব নবীর শরীর থেকে পোকা বের হত বা তাকে পোকা আক্রান্ত করেছিল এ কথা বলা সঠিক নয়। যে এ কথা বলবে সে দীনকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করবে।

ইমাম কুরতবি বলেন তাঁর আল-জামিউ লি আহকামিল কুরআন বলেন, কাজি আবু বকর ইবনুল আরবি বলেছেন,

لم يصح عن أيوب في أمره إلا ما أخبرنا الله عنه في كتابه في آيتين: الأولى قوله تعالى: ﴿ وَأَيُّوبَ إِذْ نَادَىٰ رَبَّهُ أَنِّي مَسَّنِيَ الضُّرُّ ﴾[الأنبياء: 83] والثانية في «ص» ﴿ أَنِّي مَسَّنِيَ الشَّيْطَانُ بِنُصْبٍ وَعَذَابٍ ﴾. وأما النبي صلى الله عليه وسلم فلم يصح عنه أنه ذكره بحرف واحد إلا قوله: « بينا أيوب يغتسل إذ خرّ عليه رِجل من جراد من ذهب 

অনুবাদ: আইয়ুব আলাইহিস সালামের ব্যপারে কুরআনে দুটি আয়াতে আল্লাহ আমাদের যা জানিয়েছেন এবং নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে (নিম্নের) হাদিসটি ব্যতীত একটি শব্দও বিশুদ্ধ নয়।

প্রথম আয়াতটি হল : আর আইয়ুব যখন তাঁর বরকে ডেকে বলল, আমাকে রোগ আক্রান্ত করেছে অথচ আপনি হচ্ছেন সকল দয়াশীলদের থেকেও অধিক দয়াশীল। ( সুরা আল আম্বিয়া : ৮৩)। আর দ্বিতীয় আয়াতটি হল – আর স্মরণ কর, আমার বান্দা আইয়ুবের কথা, যখন সে তাঁর রবকে ডেকে বলল, আমাকে শয়তান কষ্ট ও শাস্তি দ্বারা স্পর্শ করেছে। ( সুরা সুয়াদ : ৪১)।

আর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত হাদিসটি হল : একাবার আইয়ুব আলাইহিস সালাম (একাকি লোক চক্ষুর আড়ালে) বিবস্ত্র হয়ে গোসল করছিলেন তখন সোনার কিছু পতঙ্গ তার উপর নেমে এল। ( সহিহ বুখারি )

নবী আইয়ুব আ. ও তাঁর গায়ের রোগ । কুরআনে যা আছে

পবিত্র কুরআনে দুটি আয়াতে আইয়ুব আলাইহিস সালামের গায়ের রোগ নিয়ে আলোচনা রয়েছে। প্রথম আয়াতটি হল:

وَأَيُّوبَ إِذۡ نَادَىٰ رَبَّهُۥٓ أَنِّي مَسَّنِيَ ٱلضُّرُّ وَأَنتَ أَرۡحَمُ ٱلرَّٰحِمِينَ (83) فَٱسۡتَجَبۡنَا لَهُۥ فَكَشَفۡنَا مَا بِهِۦ مِن ضُرّٖۖ وَءَاتَيۡنَٰهُ أَهۡلَهُۥ وَمِثۡلَهُم مَّعَهُمۡ رَحۡمَةٗ مِّنۡ عِندِنَا وَذِكۡرَىٰ لِلۡعَٰبِدِينَ

অনুবাদ: আর স্মরণ কর আইয়ুবের কথা, যখন সে তার রবকে ডেকে বলল, আমাকে রোগ আক্রান্ত করেছে। অথচ আপনি তো সর্বশ্রেষ্ঠ দয়ালু। তখন আমি তার ডাকে সাড়া দিলাম। আর তার সকল দুঃখ-কষ্ট দূর করে দিলাম এবং তার পরিবার-পরিজন ও তাদের সাথে তাদের আরো অনেককে দিলাম, আমার পক্ষ থেকে রহমত এবং ইবাদাতকারীদের জন্য উপদেশস্বরূপ। ( সুরা আম্বিয়া : ৮৩,৮৪)

কোন নবীর গায়ে পোকা হয়েছিল
কোন নবীর গায়ে পোকা হয়েছিল?

অপর আয়াতটি হল :

  وَاذْكُرْ عَبْدَنَا أَيُّوبَ إِذْ نَادَى رَبَّهُ أَنِّي مَسَّنِيَ الشَّيْطَانُ بِنُصْبٍ وَعَذَابٍ 

অনুবাদ: আর স্মরণ কর, আমার বান্দা আইয়ুবের কথা, যখন সে তাঁর রবকে ডেকে বলল, শয়তান আমাকে কষ্ট ও শাস্তি দ্বারা স্পর্শ করেছে। ( সুরা সুয়াদ : ৪১)

পবিত্র কুরআনের এই দুটি আয়াতের কোনো জায়গায় আইয়ুব আলাইহিস সালামের রোগেন নাম বা ধরণ সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু বলা নেই। ঠিক একইভাবে কোনো সহিহ হাদিসে উনার রোগের নামের ব্যপারে স্পষ্ট তথ্য নেই। তাই আমরা তাঁর গায়ে পোকা হয়েছিল বলাটা ঔদ্ধত্য।

আয়াতের তাফসির

আল্লাহর নবী আইয়ুব আলাইহিস সালাম আল্লাহর পক্ষ থেকে বড় ধরণের পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছিলেন। তিনি দীর্ঘ বারো বছর কঠিন রোগে আক্রান্ত থাকার পর সফলভাবে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। অতপর আল্লাহ তায়ালা তাকে সুস্থতা দান করেন। সেই সাথে পরিবার-পরিজন ও মাল-সম্পদ দ্বিগুন করে দিয়েছিলেন। ইমাম ইবুন কাসির বলেন,

يذكر تعالى عبده ورسوله أيوب عليه السلام وما كان ابتلاه تعالى به من الضر في جسده وماله وولده حتى لم يبق من جسده مغرز إبرة سليما سوى قلبه ولم يبق له من حال الدنيا شيء يستعين به على مرضه وما هو فيه غير أن زوجته حفظت وده لإيمانها بالله ورسوله فكانت تخدم الناس بالأجرة وتطعمه وتخدمه نحوا من ثماني عشرة سنة

অনুবাদ: আল্লাহ তায়াল তাঁর বান্দা আইয়ুব আলাইহিস সালামকে তাঁর শরীর, সন্তান ও মালের ব্যপারে যে পরীক্ষা করেছিলেন, এভাবে যে, তাঁর শরীরে হৃদপিণ্ড ব্যতীত সুইয়ের ছিদ্র পরিমাণ জায়গা সুস্থ থাকেনি। দুনিয়ার কোনো কিছুই তাঁর রোগ নিরাময়ে সাহায্য করার মত বাকি থাকেনি। কেবল তাঁর স্ত্রী, আল্লাহ ও তার রাসুলের প্রতি ইমান থাকার কারণে তাঁর সেবা করে যাচ্ছিলেন। তিনি পারিশ্রমিক নিয়ে মানুষের কাজ করে তাকে আহার করাতেন। এভাবে তিনি প্রায় আটারো বছর যাবত তাঁর সেবা করে যাচ্ছিলেন। ( তাফসিরু ইবনু কাসির : খ. ৭, পৃ, ৭৪)

নবী আইয়ুব আ. ও পোকা সংক্রান্ত ঘটনার হাদিস

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

بينا أيوب عليه السلام يغتسل عرياناً، فخَرّ عليه جرادٌ من ذهب، فجعل أيوب يحتثي في ثوبه، فناداه ربّه : يا أيوب ، ألم أكن أغنيتك عما ترى ؟، قال : بلى وعزّتك، ولكن لا غنى بي عن بركتك ) راوه البخاري .

অনুবাদ: একাবার আইয়ুব আলাইহিস সালাম (একাকি, লোক চক্ষুর আড়ালে) বিবস্ত্র হয়ে গোসল করছিলেন। তখন সোনার পতঙ্গপাল তার উপর নেমে এল। আইয়ুব আ. সেগুলো কুড়িয়ে তাঁর কাপড়ে নিতে লাগলেন। তখন তাঁর রব তাঁকে বললেনঃ হে আইয়ুব, আমি কি তোমাকে এগুলো হতে অমুখাপেক্ষী করিনি? উত্তরে তিনি বললেন, হ্যাঁ, আপনার সম্মানের শপথ। অবশ্যই আপনি করেছেন। তবে আমি আপনার বরকত থেকে অমুখাপেক্ষী নই । ( সহিহ বুখারি : ২৭৯)

এই হাদিসে একাবার আইয়ুব আলাইহিস সালামের উপর আকাশ থেকে সোনার পোকা নেমে আসার কথা রয়েছে। কিন্তু এটা কোনো রোগের কারণে ছিলো না। প্রত্যেক নবীর কিছু অলৌকিক ঘটনা থাকে, এটা সে রকমই একটা ঘটনা। আর সাধারণ মানুষের বিভ্রান্তিটা এখান থেকেই। তারা মনে করে তাঁর গায়ে এসব পোকা রোগের কারণে হয়েছিল। মূলত আইয়ুব আলাইহিস সালামের রোগ ছিলে একটি ঘটনা ও সোনার পতঙ্গ ঙ্গপাল বর্ষিত হওয়া আরেকটি ভিন্ন ঘটন। তাই দুটিকে এক করা যাবে না।


শেয়ার করুন

Leave a Comment